
হাড়কাঁপানো শীতে ঢাকার সাহিত্যে উত্তাপ ছড়ানোর মধ্য দিয়ে গত ৫ জানুয়ারি শুরু হয়ে ৮ জানুয়ারি শেষ হলো ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসর। মহামারির কারণে তিন বছর বন্ধ থাকার পর এবারের আসরটি শুরু হয় যথারীতি পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা সমালোচনার মধ্য দিয়ে। লিট ফেস্টের জন্য এটা নতুন কিছু না। হে ফেস্টিভ্যাল নামে যাত্রা শুরু করার পর নামকরণ নিয়ে সমালোচনার শুরু। এরপর ফেস্টিভ্যালের নাম পরিবর্তন করেও রক্ষা হয়নি- এ দেশের লেখকদের একটা পক্ষ এই ফেস্টের সমালোচনা করেই গেছেন। মজার ব্যাপার হলো, এই সমালোচকপক্ষের আবার পরিবর্তনও ঘটে। যেমন, যিনি আগে সমালোচনা করতেন তিনি কোনো সেশনে অংশগ্রহণের নিমন্ত্রণ পেলে আর সমালোচনা করেন না। আবার যাঁরা আগের একাধিক আসরে আলোচক হিসেবে অংশ নিয়ে এই আয়োজনের প্রশংসা করেছেন, এবার দেখলাম তাঁরা আলোচক হিসেবে আমন্ত্রণ না পেয়ে নানারকম সমালোচনা করছেন। এবার সমালোচনার বাড়তি বিষয় হিসেবে যুক্ত হয়েছিল প্রবেশমূল্য নির্ধারণের বিষয়টি। কিন্তু সেইসব আলোচনা-সমালোচনা আমার এই লেখার বিষয় না। চার দিনের এই ফেস্টে কী কী ঘটল, আমি নিজে কেমন উপভোগ করলাম তার একটা আপাতচিত্র টুকে রাখতে চেষ্টা করব এই লেখার মধ্য দিয়ে।
নির্ধারিত সময়ে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে মণিপুরি, ক্লাসিক্যাল, রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে চমৎকার এক সূচনা হয় এবারের ফেস্টের। উদ্বোধন করেন নোবেলজয়ী তানজানীয়-ব্রিটিশ লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহ, ভারতীয় লেখক অমিতাভ ঘোষ ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। সঙ্গে আরও ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা এবং লিট ফেস্টের তিন পরিচালক কে আনিস আহমেদ, সাদাফ সায্ ও আহসান আকবার।
এবারের আসরে অংশ নিয়েছেন পাঁচ মহাদেশের পাঁচ শতাধিক বক্তা। চার দিনের এই উৎসবে ১৭৫টির বেশি সেশনে অংশ নেন তারা। এবারের চার দিনের এই আয়োজনে অন্য যে কোনো বারের চেয়ে বৈচিত্র্য ছিল বেশি। সাহিত্যের নানা বিষয় ও অনুষঙ্গের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সেশন, শিশু ও তরুণদের জন্য আকর্ষণীয় আয়োজন, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাট্য, সংগীত এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ছিল প্রতিদিনই। দর্শনার্থীদের অংশগ্রহণও ছিল আগের চেয়ে বেশি। বিশেষ করে প্রবেশমূল্য থাকার কারণে যে শঙ্কা ছিল সেটা আর চোখে পড়েনি।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আবদুলরাজাক গুরনাহ বলেন, 'আমি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছি। আমি ধারণা করছি এই আয়োজনের মাধ্যমে এমন কিছু দেখব যা আমি জীবনেও দেখিনি। আমি মনে করি, এই আয়োজনের শুরুটা (মণিপুরি নৃত্য) বেশ চমকপ্রদ ছিল।' অমিতাভ ঘোষ বলেন, 'আমি কিন্তু একদিক দিয়ে বাংলাদেশি। আমার মায়ের বাড়ি গোপালগঞ্জ এবং বাবার বাড়ি বিক্রমপুর। আমি বাংলাদেশে বড় হয়েছি। আমি সব সময় বাংলাদেশের কথা বলি। বাংলাদেশের ভাষা খুব চমৎকার। বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা দিন দিন আমার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে।' প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, 'এই আয়োজনের সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সব সময় যুক্ত ছিল। মহামারির কারণে এবার হয়তো সম্পৃক্ততা কমেছে। তবে ভবিষ্যতে আমরা আবার আরও ভালো করে পাশে থাকার চেষ্টা করব।' ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক এবং ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক লেখক কে আনিস আহমেদ বলেন, 'এখানে অনেক আলোচনা, বিতর্ক এবং সৃজনশীলতার স্ম্ফুলিঙ্গ দেখা যাবে। কী হবে, কী ঘটবে আগে থেকে ধারণা করা খুব কঠিন। আমরা যখন জানি কিছু একটা হবে, তখন আলোচনা সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে দাঁড়ায়।' ঢাকা লিট ফেস্টের আরেক পরিচালক সাদাফ সায্ বলেন, 'মহামারি আমাদের একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। মহামারি আমাদের শিখিয়েছে যে আমাদের একে অপরের কত প্রয়োজন। আজকে আমরা উৎসব পালন করছি এই জায়গায়।' ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক আহসান আকবার বলেন, 'আগামী চার দিন ঢাকা লিট ফেস্টের আয়োজনে আমরা একে অপরের কাছ থেকে শিখব।'
পরস্পরকে জানা-বোঝা, চিন্তার ঐক্য-অনৈক্য, বহুত্ববাদী বোধ ও সংস্কৃতির উন্মীলন- এই প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হলো লিট ফেস্টের মূল আয়োজন। এবারের ফেস্টের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন নিঃসন্দেহে নোবেলজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহ। তবে আমার নিজের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সোমালিয়ার লেখক নুরুদ্দিন ফারাহ। সমকালীন বিশ্বসাহিত্যে আমার প্রিয় লেখকদের একজন তিনি। দুটো সেশনে তাঁকে শোনার সুযোগ হলো। প্রথম দিনে 'টর্ন এপার্ট' শিরোনামের একটি সেশনে এক মঞ্চে আলোচনা করেন সোমালীয় নুরুদ্দিন ফারাহ, শ্রীলঙ্কার বুকারজয়ী লেখক শিহান কারুনাতিলাকা এবং ভারতের বুকারজয়ী গীতাঞ্জলি শ্রী। আরেকটি সেশনে একমঞ্চে আলোচনা করেন আবদুলরাজাক গুরনাহ, অমিতাভ ঘোষ ও পঙ্কজ মিশ্র। ঢাকাতে বসে এই রকম বহুদেশীয় বিশ্বখ্যাত লেখকদের একমঞ্চে দেখতে পাওয়া সত্যিই বিরল ও বিস্ময়কর ঘটনা। নুরুদ্দিন ফারাহর কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। তিনি চমৎকার করে বললেন : 'টর্ন এপার্ট শব্দটি খুব ভয়ংকর একটি শব্দ। নিজের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে নিজের অস্তিত্বের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া। রাজনৈতিকভাবে যারা নিজের দেশ, নিজের ভিটেমাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তারা ভয়ংকরতম নির্মমতার শিকার।' আরেকটি সেশনে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন কাজী আনিসের। সেখানে তিনি কেন মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরেজি ভাষায় লিখছেন এমন প্রশ্নে বলেন : 'আমি সোমালি ভাষায় একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। সেটি একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সেন্সরশিপ বোর্ড সেই বইয়ের দুটি অধ্যায় পছন্দ করেনি। আমাকে বলা হয়েছিল সংশোধন করতে, নতুবা জেলে ভরা হবে। আমি তা করিনি, যার ফলে ওই বইয়ের বাকি পাবলিকেশন বন্ধ হয়ে যায়, আর আমি অন্য দেশে চলে যাই।' নুরুদ্দিন ফারাহর মতো একই প্রশ্ন করা হয়েছিল গুরনাহকে। গুরনাহ আঠারো বছর বয়সে জাঞ্জিবার ছেড়ে ব্রিটেনে আসেন অভিবাসী হয়ে। তিনি ইংরেজি ভাষাকেই বেছে নেন তাঁর সাহিত্যের ভাষা হিসেবে। অমিতাভ ঘোষও মধ্যমণি ছিলেন একাধিক সেশনে। তিনি নিজেও বাঙালি হলেও লেখেন ইংরেজিতে। অন্যদিকে গীতাঞ্জলি প্রথম ভারতীয় হিন্দিভাষী লেখক হিসেবে সম্প্র্রতি বুকার পুরস্কার পেলেন। তাই লেখার ক্ষেত্রে বহুভাষী লেখকের ভাষাচর্চার বিষয়টি নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে। এ ধরনের এক প্রশ্নে আবদুলরাজাক গুরনাহ চমৎকার করে একটা উত্তরও দিয়েছেন। তিনি বলেন- 'আমি মনে করি লেখালেখির জন্য একটি ভাষা নির্বাচন করে নিতে হয়, বিশেষ করে যদি কারও বিকল্প থাকে। আমি কাউকে বলে দিতে চাই না, তুমি এই ভাষাতে লেখো বা লিখো না। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমি বলি, যে যে ভাষাতে লিখছেন, কেউ হতে পারে ফরাসি, কেউ বাংলা, সেটা তাদের ব্যাপার।' বিশ্বায়নের কালে ভবিষ্যতের কবিতা সেশনে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ভাষার প্রশ্নে বলেন, 'সব ভাষার মূলে হচ্ছে চেতনা। ভাষার কোনো বৈরিতা নেই। বাংলা আমার প্রকৃতির ভাষা। আরেকজনের মাতৃভাষা আরেকটা।'
খুব স্বাভাবিকভাবে সাহিত্য নিয়ে সর্বাধিক সংখ্যক সেশন ছিল। কিন্তু একসঙ্গে আটটির মতো সেশন চলায় সবগুলোতে অংশ নেওয়া একজনের পক্ষে সম্ভব হয় না। আমি আগে থেকে ঠিক করে রাখতাম কখন কোন সেশনে গিয়ে বসব। আমি আমার দেখা কয়েকটি সেশনের কথা আলাদা করে এখানে উল্লেখ করতে চাই। কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের সঞ্চালনায় 'আগামীর আখ্যান' নিয়ে আলাপ করেন সমকালীন বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ দুই কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও ইমদাদুল হক মিলন। শীতের সকাল সকাল এই সেশনটি শোনার জন্য আমার মতো আরও অনেকে ছুটে এসেছিলেন। নজরুল মঞ্চে কবি শামীম রেজার মুখোমুখি হন কবি জয় গোস্বামী। প্রায় দুই ঘণ্টার এই সেশনটিও ছিল উপভোগ্য। হামীম কামরুল হকের সঞ্চালনায় 'বাঙালির চিন্তার ইতিহাস' শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন সলিমুল্লাহ খান এবং তপধীর ভট্টাচার্য। এ দুই প্রাবন্ধিক, চিন্তক ও অধ্যাপকের আলোচনাটি আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। 'কথাসাহিত্যের ভিতর বাহির' শীর্ষক সেশনে মোস্তাক আহমেদের মুখোমুখি হন লেখক মাসরুর আরেফিন। প্রায় দুই ঘণ্টার এই সেশনে তিনি তাঁর লেখায় ’state phobia' বা রাষ্ট্রাতঙ্ক বিষয়টি কীভাবে এসেছে তা নিয়ে কথা বলেন। প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত সিস্টেম, এই সিস্টেমকে মোকাবিলা করার বিমূর্ততা, লেখায় মেটিফিজিক্যাল অ্যাবস্ট্রাকশন কেন প্রয়োজন, 'জ্ঞান' কেন ও কীভাবে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে দেশের বিরাট সংখ্যার মানুষকে মানুষ বলেই না ভাবতে এমন অনেক অপ্রচলিত বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেন তিনি।
আরও অনেক সেশন ভালো লাগলেও আমার নিজের আগ্রহ থাকে সাহিত্যের বাইরের সেশনগুলোতে। নতুন অনেক কিছু জানা যায় সেখান থেকে। এবার যেমন অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের সহ-উদ্ভাবক সারাহ গিলবার্ট, বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা, বিশ্বখ্যাত বাংলাদেশি স্থপতি মেরিনা তাবাসসসুম, অস্কারজয়ী ব্রিটিশ অভিনেত্রী টিল্ডা সুইনটন- তাঁদের সেশনগুলো আমি শুনেছি। সাফ ফুটবল বিজয়ী নারী দলের সদস্যরা এসেছিলেন তাঁদের কোচের সঙ্গে। ছাদখোলা বাসে ঢাকা কাঁপানো কিশোরীদের দেখলাম সামনে বসে। এই লড়াকু মেয়েদের কথা আমাদের সকলকে আর্দ্র করেছে। আদিবাসীদের ভাষা-সংস্কৃতি ও তাদের নিয়ে গড়ে ওঠা সামাজিক ধারণা এবং এসব ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন সেই গল্প শুনলাম লেখক ইয়াং ইয়াং ম্রো, উদ্যোক্তা প্রিয়াঙ্কা চাকমা, পরিচালক অং রাখাইনের মুখ থেকে। 'পুরুষত্ব বনাম পুরুষতন্ত্র' শিরোনামের সেশনটিও ছিল আগ্রহ-উদ্দীপক। ইরেশ যাকের, আজমেরী হক বাঁধন, নবনীতা চৌধুরী, তাকবির হুদা, মাহীন সুলতান, সাঈদ আহমেদ এবং তাসাফি হোসেন এই সেশনে অংশ নেন। সঞ্চালনা করেন বন্যা মির্জা। 'দ্য অ্যাপেল অ্যান্ড দ্য ট্রি' শিরোনামের সেশনে সাংবাদিক সরদ কুতনের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের মেয়ে, লেখক ও সমাজকর্মী মারিনা মাহাথির। এই সেশনটিও উপভোগ্য ছিল। উল্লেখ করতে ভুলে গেছি, এবার জেমকন সাহিত্য পুরস্কারের অনুষ্ঠানটি আমি মিস করেছি। তবে পাঠকদের জানিয়ে রাখি, এ বছর 'স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে' কাব্যগ্রন্থের জন্য জেমকন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কবি কামাল চৌধুরী। তরুণ শ্রেণিতে 'ঘুমিয়ে থাকা বাড়ি' পাণ্ডুলিপির জন্য জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার পেয়েছেন সাকিব মাহমুদ ও 'সোনার নাও পবনের বৈঠা' উপন্যাসের জন্য তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন সাজিদুল ইসলাম। শেষ দিন আমি হঠাৎ কী মনে করে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে চমকে গেছি। দেখি কথা বলছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ স্যার গর্ডন গ্রিনিজ। এই সেশনটি সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিল না। ক্রিকেট অনুরাগী হিসেবে আমি সানন্দে বসে গেলাম হলভর্তি দর্শকের মাঝে। ইউসুফ রহমান বাবুর সঞ্চালনায় স্যার গর্ডন গ্রিনিজের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন জিম্বাবুয়ে জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। ক্রিকেটের টেকনিক্যাল অনেক কিছু জানা হলো তাদের মুখ থেকে। সংগীত নিয়েও বেশ কিছু আয়োজন ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কনসার্ট তো হতোই। কোক স্টুডিও বাংলার নেপথ্যের গল্প শোনালেন সংগীতশিল্পী বুনো, আবির রাজবিন এবং চিত্রনাট্যকার গাওসুল আলম শাওন। কুষ্টিয়ার একটি যাত্রাদল যাত্রাপালা প্রদর্শন করে বর্ধমান হাউসের সামনে। উপচেপড়া দর্শকের ভিড়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রাজধানীতে বাস করা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যাত্রাপালা দেখেনি। বিদেশি অতিথিরাও দেখলাম আগ্রহ নিয়ে যাত্রা দেখছেন। চলচ্চিত্র নিয়ে আমার কোনো আলোচনা শোনার সুযোগ হয়নি। তবে 'মশারি' ও 'রিকশাগার্ল' ?সিনেমা দুটি দেখেছি। এবার চমকপ্রদ আয়োজন ছিল শিশুদের জন্য। আগের বছরগুলোতে শিশুরা উপেক্ষিত ছিল বলা চলে, এবার সেটি পুষিয়ে দেওয়া হয়েছে। লিট ফেস্টে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিশুদের দেখতে পাওয়া ছিল আনন্দের বিষয়।
লিট শেষ হলো কোক স্টুডিও বাংলার কনসার্ট দিয়ে। এ সময় আর পা রাখার জায়গা ছিল না একাডেমির চত্বরে। আমি অবশ্য কনসার্ট শুরু হওয়ামাত্রই বের হয়ে এসেছি। একটু খারাপই লাগছিল। চারটি দিন যখন যে বিষয় ভালো লেগেছে সেই বিষয়ে কথা শোনার জন্য বসে গেছি দর্শকসারিতে। ক্লান্তি অনুভব করলে চলে গেছি কফির টানে ফুডকোর্টে বা লিট ফেস্টের লেখক লাউঞ্জে। যেহেতু এটা কথিত 'এলিট' ফেস্ট তাই তুলনামূলকভাবে অব্যবস্থাপনা খুবই কম। এত মানুষের মধ্যেও পরিস্কার চত্বর। প্রতিটা সেশন নির্ধারিত সময়ে শুরু ও শেষ। অবশ্য ঢাকার লেখকদের কিছু সেশন নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি। কেউ কেউ তো ঘোষণা দিয়ে মাইক ছাড়তে চাননি! পাশাপাশি দেশি-বিদেশি লেখকদের সেশন শুনলে বোঝা যায়, আমাদের লেখকদের পরিমিতিবোধ কম। আলোচ্য বিষয় থেকে ছুটে গিয়ে কথা বলার প্রবণতা আবার বেশি। তবে 'আমরা তো আমরাই, আমাদের যা কিছু সবই ভালো'! এই ঘোষণাটুকু না আমার 'নন-এলিটিস্ট' স্ট্যাটাসটা পরিস্কার করে নিতে চাই।
ফেস্টটা শেষ পর্যন্ত কেমন হলো, সেটা আমি আমার প্রিয় লেখক নুরুদ্দিন ফারাহর মুখ থেকে শোনাতে চাই। তিনি সমাপনীর মঞ্চে বললেন, 'আমি যখন কেপটাউনে ফিরে যাব। আমার বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করবে- এখানে কী হয়েছে, কারা এসেছে? আমি বলব, এই উৎসব অন্যান্য উৎসব থেকে একেবারেই ভিন্ন। আমি এখানে নেমে যা ধারণা করেছিলাম তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাকে যখন জিজ্ঞেস করবে- কী সংখ্যক মানুষ শুনতে এসেছিল? আমি বলব- ডোনাল্ড ট্রাম্পের অ্যানিভারসারি থেকেও বেশি মানুষ এসেছিল (মজার ছলে বলেন)। এখানকার খাবার চমৎকার। আয়োজকদের ব্যক্তিগত বাড়িতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ। তাদের ধন্যবাদ জানাই। এই আয়োজন থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি, আশা করি আপনারাও শিখেছেন।'
আমার ছোট্ট করে অব্যক্ত উত্তর- হ্যাঁ শিখেছি। আবারও এই ফেস্ট হলে শিখতে চলে আসব। আর বাসায় ফিরে লিট ফেস্ট বিরোধীদের স্ট্যাটাসগুলো পড়ে 'আফসোস' করব! আমি চাই না ঢাকার সব ফেস্ট একরকম করে হোক, সমাজে যেমন চিন্তার স্তর আছে, আছে মানুষের সামাজিক অবস্থানগত পার্থক্য, এমনকি সাংস্কৃতিক ভাষাগত পার্থক্যও এই শহরের সৌন্দর্যের অংশ, তাই যা কিছু আলাদা তা আলাদাই থাক, আমাদের যা গ্রহণ করার করব, যা বর্জন করার সেটিও করতে পারব।
মন্তব্য করুন