ভারত ম্যাচটাই ছিল বদলে যাওয়ার, বদলে দেওয়ার! সেদিন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের আক্রমণের বানে ভেসে যাওয়া দূরে থাক, উল্টো তাদের গোলই উদযাপন করতে দেননি বাংলাদেশের মেয়েরা। এর নেপথ্যের নামটি তো রুপনা চাকমাই।

ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকে ভারতের আক্রমণ যেন বাংলাদেশের রক্ষণ দেয়ালে কম্পন সৃষ্টি করে। কিন্তু একবারের জন্যও শেষ দেয়ালটি ভাঙতে পারেনি। ম্যাচের পর ভারত কোচ ময়মল রকি বাধ্য হন রুপনার গলায় প্রশংসার মালা পরাতে, 'আমরা রুপনার জন্যই জিততে পারিনি।' 

সেই ম্যাচে রুপনার এমন কিছু দুর্দান্ত সেভ মনে করিয়ে দেয়, কাতার বিশ্বকাপে আলো ছড়ানো আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজকে। তাতেই রুপনার গায়ে লাগে মার্টিনেজ তকমা। এর পর ফাইনালে নেপালের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ে চারদিকে থেকে আসতে থাকে অভিনন্দনের বার্তা। সেখানেও কেউ কেউ তাঁকে মার্টিনেজের সঙ্গে তুলনা করেন। 

গতকাল শুক্রবার বাফুফে ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে রুপনাও স্বীকার করে নিলেন মার্টিনেজকে কতটা পছন্দ করেন তিনি। গোলপোস্টের নিচে তাঁর চৌকস প্রহরীর ভূমিকা দেখে চোখ জুড়ায় রুপনারও, 'ভারতের সঙ্গে যখন একটা সেভ দিছিলাম, সবাই এসে বাহবা দিয়েছেন। 

জুনিয়ররা বলেছে, 'আপু, আপনি মার্টিনেজের মতো সেভ দিয়েছেন। এটা শুনে ভালো লেগেছে। আসলে সবাই বলছেন, ভারতের সঙ্গে ওই সেভটা না হলে আমরা হেরেও যেতে পারতাম। তাই সেভটার এত গুরুত্ব।' বাংলাদেশ দলে আপাতত রুপনার নাম মার্টিনেজ হলেও তিনি কিন্তু আইডল চেয়ারে ব্রাজিলের আলিসন বেকারকেই রেখেছেন, 'হ্যাঁ মার্টিনেজকে ভালো লাগে ঠিক। তিনি অনেক ভালো খেলেছেন। তবে আমার প্রিয় গোলকিপার ব্রাজিলের আলিসন বেকার।'

সাফ অনূর্ধ্ব-২০ টুর্নামেন্ট জয়ের পেছনে যাঁর অবদানটা অনেক বেশি। গ্লাভস হাতে যিনি ছিলেন নায়কের ভূমিকায়। সেই রুপনার আদর্শ খাতায় কিন্তু শুধু মার্টিনেজ নন, আছেন বেকারও। দুই দর্শকনন্দিত দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার নাম্বার ওয়ান দুই গোলকিপারকে যিনি চিত্তে ধারণ করেন, তাঁর তো সেরা হওয়াই সাজে। সদ্য শেষ হওয়া এই টুর্নামেন্টেও তাই হলো। সেরা গোলকিপারের পুরস্কারটা রুপনার হাতে উঠেছে। এমন প্রাপ্তির দিনে হয়তো রুপনার মনে পড়বে অতীতের দিনগুলো। মনে পড়বে মায়ের প্রেরণার কথা। মা-ই যে তাঁকে ফুটবলে আসতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। রুপনার বাবা নেই। মা কালাসোনা চাকমাই তাঁর সব। গোল আটকানোর গ্লাভসটা তো মায়ের হাত থেকেই প্রথম নিয়েছিলেন। 

২০১১ সালের কথা, সে সময় প্রথমবার রাঙামাটি জেলা স্টেডিয়াম মাঠে খেলতে নামেন রুপনা। তাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ হন স্থানীয় মগাছড়ি স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বীর সেন। রুপনা তখন রাঙামাটির নানিয়ারচরের ভুয়াদম গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থী। বীর সেন এতটাই মুগ্ধ হন, তড়িঘড়ি করে তাঁর মাকে রাজি করিয়ে মগাছড়ি স্কুলে ভর্তি করিয়ে নেন। আর রুপনার পড়ালেখা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন স্থানীয় কোচ শান্তি মনি ও সুইহ্লা মং। 

স্কুলের একটি কক্ষে অন্য মেয়েদের সঙ্গে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। আশপাশ থেকে সবার এত এত সহযোগিতা পেয়ে স্কুল টুর্নামেন্টে নিজেকে প্রমাণ করেন রুপনা। দ্যুতি ছড়িয়ে জায়গা করে নেন বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলে। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তরতর করে ওপরের দিকে এগোতে থাকে রুপনার প্রাপ্তির গ্রাফটা।