ফুটবলের জনপ্রিয় দেশে জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রেমে পড়েন। ইংল্যান্ডের সাবেক ফুটবলার ওয়েন রুনি-ডেভিড বেকহামের মতো তারকা হওয়ার স্বপ্নও বুনেছিলেন ইমরানুর রহমান। সেই স্বপ্নের পরিধি আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসে তাঁর। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের প্রতি ভালোলাগা জন্মে ইমরানের মনে। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা; স্প্রিন্টকে বেছে নেন ক্যারিয়ার হিসেবে। শুধু বেছেই নেন না, মা-বাবার জন্মস্থান বাংলাদেশের প্রতিও আগ্রহ বেড়ে যায় তাঁর। জন্ম লন্ডনে হলেও লাল-সবুজের প্রতি টান ছিল ইমরানের। শিকড়ের টানে এ দেশে এসে ঘরোয়া অ্যাথলেটিকসে গড়েছেন রেকর্ড। সেগুলোও ছাপিয়ে নতুন ইতিহাস গড়েছেন ২৯ বছর বয়সী এই স্প্রিন্টার। ক'দিন আগে কাজাখস্তানের আস্তানায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপের ৬০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণ জিতেছেন; স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসে সেরা সাফল্য। মঙ্গলবার রাতে ঢাকায় আসার পর বুধবার সমকাল কার্যালয়ে আসেন ইমরান। সেখানেই নিজের জীবনের গল্পগুলো শুনিয়েছেন দেশের অ্যাথলেটিকসের নতুন রাজপুত্র।
সমকাল :অ্যাথলেটিকসে উঠে আসার গল্প...
ইমরান: আমি অ্যাথলেটিকস শুরু করেছি ১৯ বছর বয়সে। তবে তার আগে থেকেই অ্যাথলেটিকসের প্রতি ঝুঁকে পড়ি। এই খেলার আগে আমি ফুটবল নিয়েই পড়ে থাকতাম বেশি। শখ হিসেবে ফুটবল খেললেও একেবারে খারাপ খেলতাম না। লন্ডনে একটি ক্লাবে আমি ট্রেনিং করতাম, সেখান থেকেই মূলত অ্যাথলেটিকসের প্রেমে পড়া শুরু। আর বাংলাদেশের প্রতি আমার ভালোলাগা ও ভালোবাসা আগে থেকেই ছিল। সর্বশেষ ২০১৭ সালে রকিব স্যারের (আবদুর রকিব মন্টু) সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তবে ইনজুরির কারণে লন্ডন গেমসে খেলতে পারিনি। এর পর করোনা আরও পিছিয়ে দিয়েছিল। মূলত কভিডের কারণেই বাংলাদেশের হয়ে খেলতে আমার দেরি হয়েছে। দেশের হয়ে খেলতে পেরে এখন আমি গর্বিত।
সমকাল :ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশের সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে বাংলাদেশকে বেছে নেওয়ার কারণ?
ইমরান: বাংলাদেশে আমার মা-বাবা জন্মগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের প্রতি আমার টান থাকার বড় কারণ হলো মা-বাবা। আর ইংল্যান্ডে যে বাংলাদেশি কমিউনিটি আছে, সেখানেও তাদের অনেক সমর্থন পাই। এই দেশের মানুষের ভালোবাসার কথা তো না বললেই চলে। বলতে পারেন, শিকড়ের টানেই আমার বাংলাদেশকে বেছে নেওয়া।
সমকাল :গলায় সোনার পদক পরার সময় সাউন্ডবক্সে 'আমার সোনার বাংলা' জাতীয় সংগীত বেজে ওঠার সময় কেমন লেগেছে?
ইমরান: সেই মুহূর্তটি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। অবিশ্বাস্য এবং অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করেছিল। আমি স্বর্ণ জেতাতেই অ্যাথলেটিকসে বিদেশের মাটিতে লাল-সবুজ পতাকা উড়েছে। যখন জাতীয় সংগীত বেজে উঠেছে, তখন খুব আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। কিছুক্ষণ চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ১০ বছর ধরে অ্যাথলেটিকস খেলছি। এই স্বর্ণপদক বাংলাদেশের মানুষের জন্য। আশা করি, ভবিষ্যতে আরও সফল হতে পারব।
সমকাল :মা-বাবা কী বলেছেন?
ইমরান: সন্তানের সাফল্যে সব মা-বাবাই গর্ববোধ করেন। আমার সাফল্যে তাঁরা অনেক খুশি। আমার স্ত্রী-কন্যাও উচ্ছ্বাস করেছে।
সমকাল :বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডে। বাংলাদেশ সম্পর্কে কতটা জানা আছে আর বাংলায় গান গাইতে পারেন?
ইমরান: জানি (হেসে), তবে আমি বলতে পারি না। মা-বাবার মুখে গান শুনেছি। আর বাংলাদেশের মধ্যে আমি সিলেটে গিয়েছি। ছোটবেলায় ২০০৪ সালে একবার কক্সবাজারে গিয়েছিলাম। সেই সময় আমি অ্যাথলেট ছিলাম না। সুন্দরবন সম্পর্কে জানি না; শ্রীমঙ্গল আর জাফলংয়ে গিয়েছি।
সমকাল :নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছেন?
ইমরান: হ্যাঁ, আমার মা-বাবার মুখ থেকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের কথা শুনেছি। সময় পেলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ঘুরে আসব।
সমকাল :স্প্রিন্টকে বেছে নেওয়ার কারণ?
ইমরান: শুরুতে ফুটবল খেলেছিলাম। ইংল্যান্ডে ফুটবল একাডেমি থেকে যে ট্যালেন্ট হান্ট হয়, সেখানে বেশি উচ্চতা হলেই সুযোগ পাওয়া যায়। এটি টেকনিক্যাল খেলা। পাস, ড্রিবলিং- সবকিছুতেই টেকনিক লাগে। আর স্প্রিন্টে অতটা টেকনিক ব্যবহার করতে হয় না। যে কারণে আমি এই খেলাটাকে বেছে নিয়েছি।
সমকাল :লন্ডনে দুটি চাকরি করছেন আপনি। পাশাপাশি পড়ালেখাও শেষ করেছেন। অ্যাথলেটিকসের জন্য সময় বের করাটা নিশ্চয় সহজ নয়।
ইমরান: বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস সায়েন্স অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশনে ব্যাচেলার্স করেছি। দুটো চাকরিও করতে হয়। তার পরও সময় বের করে নিতে হয়। আসলে অ্যাথলেটিকসই এখন আমার সবকিছু। এ জন্য নির্দিষ্ট ডায়েট করতে হয়, সময় মেনে জিম করতে হয়। সব মিলিয়ে একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে থাকতে হয়। সেটা আমি বেশ উপভোগ করি।
সমকাল :ইংল্যান্ডে বসবাসরত উপমহাদেশের মানুষের কাছে ক্রিকেট জনপ্রিয়...
ইমরান: এটা ঠিক, ইংল্যান্ডে ফুটবল জনপ্রিয়। তবে ক্রিকেটেও তারা সফল হয়েছে। ইংলিশ ক্রিকেটার জো রুট আমার স্কুলে গিয়েছিল। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ক্রিকেটকে ভালোবাসে। ছেলেমেয়েদের ক্রিকেটের প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে। এর বড় কারণ ক্রিকেটে প্রচুর অর্থ। অ্যাথলেটিকসে বেশি অর্থ নেই। আর ট্র্যাক কম থাকায় অ্যাথলেটিকসের প্রতি আগ্রহ কম। আমি মনে করি, এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপের সাফল্যে অ্যাথলেটিকসের প্রতি আগ্রহ বাড়বে অনেকের।
সমকাল :ইংল্যান্ডে তো অনেক সুযোগ-সুবিধা পান। কী পেলে বাংলাদেশের মানুষও এই খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়বে?
ইমরান: আমার সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সগুলো কিছুটা হলেও অ্যাথলেটিকসের প্রতি এ দেশের মানুষের আগ্রহ আরও বাড়িয়েছে। আমি মনে করি, স্কুল-মাদ্রাসায় যে প্রতিযোগিতার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন, এখান থেকে অনেক ট্যালেন্ট উঠে আসবে। ফাউন্ডেশনটা যদি মজবুত হয়, তাহলে আপনি খুব দ্রুতই টপ লেভেলে খেলতে পারবেন।
মন্তব্য করুন