১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। নতুন রাষ্ট্র। পাকিস্তান নামে কোনো ভূখণ্ড পৃথিবীর মানচিত্রে আগে ছিল না। প্রথম থেকেই পাকিস্তানের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় মুষ্টিমেয় সামন্তবাদী পরিবার ও সেনাবাহিনীর হাতে। ধীরে ধীরে সামন্তবাদী শক্তি দুর্বল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন-সহযোগিতায় সেনাবাহিনী শক্তিশালী হতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ববাংলা, পরে পূর্ব পাকিস্তানকে তাঁদের শোষণের অবাধ ক্ষেত্রে পরিণত করতে চান। সে উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা 'বাংলা'র পরিবর্তে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। বরকত, সালাম, রফিক, শফিকসহ অনেকের জীবনের বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির প্রথম বিজয় অর্জিত হয়। তারপর ১৯৫৪ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের কবর রচনা করে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। কিন্তু সে বিজয় বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানের আদমজী জুট মিলে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা বাধিয়ে জরুরি আইন ঘোষণা করে সে বিজয় ছিনিয়ে নেন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা। শুরু হয় একের পর এক ষড়যন্ত্র। ১৯৫৮ সালের ৮ অক্টোবর পাকিস্তানের লৌহমানবখ্যাত ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন এবং সারাদেশে সামরিক আইন বলবৎ করেন। সব রাজনীতিবিদকে জেলে ঢোকান। সারাদেশে এক থমথমে ভাব।

১৯৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। সেটাই ছিল আইয়ুববিরোধী প্রথম আন্দোলন। ১৯৬২ সালের ৮ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে তিনি সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন। ফলে পুনরায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হয়। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় বিরোধী দলগুলোর এক কনভেনশন। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি পেশ করলে কণ্ঠভোটে তা বাতিল হয়ে যায়। ওই কনভেনশনে উপস্থিত ৭৪০ জন প্রতিনিধির মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সদস্য ছিলেন মাত্র ২১ জন। ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করে 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' এবং তারা ১১ দফার আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে।

সে আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে থাকেনি। মিটিং-মিছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়। বাইরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘাঁটি গাড়ে। ভেতরে শিক্ষার্থীদের সরকারবিরোধী কার্যক্রম চলতে থাকে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন ড. শামসুজ্জোহা এবং সহকারী প্রক্টর ছিলেন ইতিহাসের ড. কসিমুদ্দিন মোল্লা ও বাংলার আব্দুল খালেক। তাঁদের কাজ শতগুণ বেড়ে যায়। ড. জোহা আমার শিক্ষক। তাঁর কাছে ভৌত রসায়ন পড়েছি দু'বছর। তিনি ছিলেন ছাত্রবান্ধব একজন শিক্ষক। সদালাপী; সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকত। ছাত্রছাত্রীদের সব রকম কর্মকাণ্ডে জোহা স্যার অংশগ্রহণ করতেন স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে। তাঁকে সবসময়ই পেত শিক্ষার্থীরা। তিনি অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীকে নাম ধরে ডাকতেন। আমরা সব সময় তাঁর নির্দেশ মেনে চলতাম। ক্যাম্পাসের শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত হতেন না। তাই সবার কাছেই তিনি ছিলেন সমান ভালোবাসার পাত্র। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। সেই উত্তাল দিনগুলোতে আমাদের মতো জুনিয়র শিক্ষকরাও তাঁর পাশে ছিলাম।

১৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের রীতিমতো সংঘর্ষ চলছিল। ড. জোহা আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন ছাত্রদের সরিয়ে আনতে। কাজটা সহজ ছিল না। ফেব্রুয়ারির শুকনো আবহাওয়া। ক'দিন ধরে লু হাওয়া বইছে। ছাত্র-শিক্ষক সবার চোখেমুখে ক্লান্তি; সেই সঙ্গে দৃঢ় প্রত্যয়। জোহা স্যার সবাইকে শহীদুল্লাহ্‌ কলাভবনের আমগাছের নিচে শহীদ মিনারের কাছে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিহতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে রাতারাতি ওই শহীদ মিনার গড়ে তোলা হয়েছিল। সেখানেই দাঁড়িয়ে ড. জোহা তাঁর জীবনের শেষ বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁর কণ্ঠের দৃঢ়তা ও চোখেমুখে যে ভাবাবেগ ছিল, তা প্রত্যেকে উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন- 'ছাত্রদের রক্তপাতের আগে আমার রক্তপাত হবে।' সে কথা শুনে ছাত্রছাত্রীরা স্যারের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠেছিল। কে জানত যে পরদিনই তাঁর কথা সত্যে পরিণত হবে!

১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ড. জোহার পরিচয় জানার পরও প্রধান গেটের ১৫-২০ গজ দূরে রাস্তার অন্যপাশে প্রথমে তাঁকে গুলিবিদ্ধ; পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

ড. জোহার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীর কারফিউ ভেঙে পড়ে। ছাত্র-শিক্ষক সবার গন্তব্যস্থল প্রধান গেট। স্যারের মৃত্যুর খবর সত্যি কিনা- সবাই জানতে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। গেটের উল্টোদিকে একটি ছোট ঘর ছিল। সেখানে এক ভণ্ড পীর আস্তানা গেড়েছিল। সেখানে সন্ধ্যার পর মদ-গাঁজার আসর বসত। তার পশ্চিম পাশে দুটি খড়ের গাদা ছিল। লু হাওয়া বইছে। কে যেন খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দিলে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। কাজলা, বিনোদপুরসহ চারদিক থেকে মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ছুটে আসছে। কেউ কারফিউর তোয়াক্কা করছে না। সেনাবাহিনী তাদের গাড়ি করে জোহা স্যারকে নিয়ে শহরে চলে গেছে। পাকিস্তান ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্লোগান বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশ-বাতাস উত্তেজিত করে তোলে। শোনা গেল ড. জোহাকে মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে গেছে। খালেক সাহেবের সঙ্গে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবাসে করে মিউনিসিপ্যালিটিতে যাই। ঢুকতেই দেখি সামনে একটি কাঠের টেবিলের ওপর স্যারের নিথর দেহটা পড়ে আছে। কখন তাঁর মৃত্যু হয়েছে- এ নিয়ে সেনাবাহিনীর একজন মেজরের সঙ্গে বচসা হয়। তাঁকে হাসপাতালে না নিয়ে যাওয়ার অর্থ, তাঁর মৃত্যু বিশ্ববিদ্যালয় গেটের পাশেই হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবাসে করে স্যারের মরদেহ প্রথমে তাঁর পূর্বপাড়ার বাসার সামনে নেওয়া হয়। ভাবি ও ৩ বছরের ফুটফুটে মেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ছাত্রছাত্রীদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে আসে। স্যারকে শেষবার দেখার জন্য শুরু হয় ঠেলাঠেলি।

মরদেহ ক্যাম্পাসে নিয়ে আসার আগেই সিনিয়র শিক্ষকরা উপাচার্য অধ্যাপক শামসুল হকের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর কবরের স্থান নির্বাচন করেন এবং কবর খোঁড়া হয়। উপাচার্যের বাড়ির দেয়ালের দিকে কফিনটা রেখে মাঠে হাজার হাজার মানুষ সারি বেঁধে দাঁড়ায়। সেন্ট্রাল মসজিদের ইমাম জানাজা পরিচালনা করেন। অতঃপর তাঁকে শেষ গন্তব্যে শুইয়ে দেওয়া হয়।

১৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আশপাশের মানুষ একটি মিছিল করে শহরের দিকে যাত্রা করেন। সিনিয়র শিক্ষকরা সামনে। শিক্ষকদের পেছনে ছাত্রীরা। মিছিলটির পাকিস্তানবিরোধী ও 'জয় বাংলা' স্লোগান জানান দেয়- পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে। তার পর থেকে সারাদেশের মানুষ প্রতিদিন স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহ্বান জানাতে থাকে। পুলিশ-সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রতিদিন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ৯ মাসের রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ; জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। ড. শামসুজ্জোহার আত্মদান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী মাইলফলক।

আজ সেই ১৮ ফেব্রুয়ারি। স্যারের প্রতি জানাই হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

শহিদুল ইসলাম: প্রাক্তন অধ্যাপক, ফলিত রসায়ন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়