- খেলা
- ঘুষ ছাড়া মেলে না সেচ সংযোগ, জিম্মি কৃষক
ঘুষ ছাড়া মেলে না সেচ সংযোগ, জিম্মি কৃষক

মাদারগঞ্জ উপজেলায় কৃষিজমিতে সেচ সংযোগ পেতে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয় বলে জানিয়েছেন কৃষিজীবীরা। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিসের নিয়োজিত টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে এ টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিএডিসির প্রতিবেদনের জন্যও ঘুষ দিতে হয়। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ অফিসের কর্মচারীদের নিয়োজিত দালালদের চাহিদাও পূরণ করতে হয়।
চর কামারিয়া ও জোড়খলী এলাকার কৃষকরা জানান, সেচ সংযোগ পেতে অনেক টাকা লাগে। হয়রানি তো আছেই। এসব ঝামেলা এড়িয়ে অনেক কৃষক আবাসিক মিটার থেকে দেড় ঘোড়ার মোটরের মাধ্যমে জমিতে সেচ দিচ্ছেন। কিন্তু এখানেও বিদ্যুৎ অফিসের বিলিং রাইটাররা এসে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়ে যান। অভিযোগ রয়েছে, সেচের সংযোগ পেতে ৪০ শতাংশ গ্রাহককে ঘুষ দিতে হয়। কথায় কথায় দালাল ও টেকনিশিয়ানরা নিজে ‘অমুকের লোক, তমুকের লোক’ পরিচয় দিয়ে স্বার্থ হাসিল করছেন।
গুনারীতলা ইউনিয়নের আব্দুল খায়ের বলেন, ‘সেচ সংযোগ পাওয়ার জন্য মেহেরুন নামের এলাকার এক ব্যক্তিকে ৬০ হাজার টাকা দিয়েছি। অতিরিক্ত টাকা দিয়েও সংযোগ পাইনি। আমার মতো এলাকার আরও ১৫ জন টাকা দিয়েছেন।’
বাকুরচর দিকপড়া এলাকার মোগল মিয়ার ভাষ্য, পল্লী বিদ্যুতের টেকনিশিয়ান শফিকুলের মাধ্যমে দেড় মাস আগে সেচের মিটারের জন্য আবেদন করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ৮০ হাজার টাকার চুক্তি হয়; কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ হয়নি।
বিএডিসির অফিসে সেচ সংযোগ পেতে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আবেদনের পর বিএডিসির একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরে প্রতিবেদন উপজেলা সেচ কমিটির কাছে জমা দিতে হয়। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উপজেলা সেচ কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে সংযোগ দেওয়ার জন্য পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কাছে চূড়ান্ত তালিকা দেন। সূত্রমতে, চলতি মৌসুমে মাদারগঞ্জ উপজেলায় গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য ৭টি ইউনিয়নের তিন শতাধিক কৃষকের আবেদন জমা পড়েছে মেলান্দহ বিএডিসির কার্যালয়ে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৪০টি সেচ সংযোগের অনুমোদন দেয় সেচ কমিটি। এই কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্য সচিব বিডিসির উপসহকারী প্রকৌশলী আসিফ ইকবাল।
মাদারগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ জোনাল অফিসের সহকারী ম্যানেজার আহসান কবির জানান, ৭টি উপজেলায় এক হাজার ৫০০ সেচ সংযোগ রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে নতুন আরও ৩২০টি সংযোগের অবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৮০টি সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সেচ সংযোগের সরকারি খরচ হিসাবে গ্রহীতাকে ১১৫ টাকা দিয়ে আবেদন করতে হয়। জামানত ২ হাজার ৪০০ টাকা ও সদস্য ফি ৫০ টাকা খরচ করতে হয় সেচগ্রহীতাকে। আর ১৩০ ফুটের বেশি বোরিং (নলকূপ খনন) করলে খুঁটি ও তার ফিটিংসের জন্য আলাদা খরচ বহন করতে হবে। মাদারগঞ্জে পল্লী বিদ্যুতের অনুমোদিত ১৭ জন টেকনিশিয়ান সেচ সংযোগের টেকনিক্যাল কাজটি করে থাকেন। এর বাইরে টেকনিশিয়ানের কাজ নেই বলে দাবি করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, সেচ কমিটির সদস্য সচিব আসিফ ইকবাল সরেজমিন তদন্ত না করে টেকনিশিয়ান হান্নানের মাধ্যমে সেচ সংযোগের ছাড়পত্র দিয়ে থাকেন।
চরনগর গ্রামের মোসলেম উদ্দীনের অভিযোগ, গত বছর সেচ সংযোগ নিতে আবেদন করেন তিনি। অবেদন প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপের জন্য অফিসে ঘোরাঘুরি করার পর তাঁরা বিভিন্ন অজুহাত দেখাতে থাকেন। বাধ্য হয়ে স্থানীয় ইলেকট্রিশিয়ান শফিকুলের সঙ্গে ৭৫ হাজার টাকা চুক্তিতে সংযোগ পেয়েছেন।
গুনারীতলা ইউনিয়নের রোকনের ভাষ্য, কৃষিজমিতে সেচ সংযোগের জন্য তাঁর মা মেহেরুন নেছার নামে গত বছর আবেদন করা হয়। এ জন্য হুদা নামের এক দালালকে অতিরিক্ত ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এর পরও টাকা দাবি করায় তাঁর সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। টাকা না দেওয়ায় সেচ সংযোগ নিয়ে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করেন।
পরিচয় গোপন করে সেচ সংযোগ নিয়ে পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিসের অনুমোদিত ইলেকট্রিশিয়ান নূর ইসলামের সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদক। তখন তিনি জানান, বিএডিসির অফিসের প্রত্যয়নসহ অন্যান্য কাজের জন্য তাঁকে অতিরিক্ত ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে। আর পুরো কাজের চুক্তির জন্য টাকার পরিমাণ বাড়বে।
বাকুরচর দিকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম বলেন, ‘আমি নিজেও অফিস খরচের জন্য এক টেকনিশিয়ানকে ১২ হাজার টাকা দিয়েছি। আমার গ্রামের সাধারণ কৃষক নিজের আবাসিক মিটার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে নিম্ন ক্ষমতাসম্পন্ন মোটর দিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে থাকেন। এ কারণে বিদ্যুৎ অফিসের মিটার রিডার টাকার জন্য বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখান। সবার তো এত টাকা খরচ করে সেচ সংযোগ স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না।
তবে সেচের প্রত্যয়নের নামে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিএডিসির উপসহকারী প্রকৌশলী আসিফ ইকবাল। তিনি বলেন, ‘সেচ সংযোগের কিছু বিষয়ে তদন্ত ছাড়া আমাদের কোনো কাজ নেই। অনুমোদন দেয় উপজেলা সেচ কমিটি ও বাস্তবায়ন করে বিদ্যুৎ অফিস।’
অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই বলে দাবি করেন পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বিএডিসির সংশ্লিষ্টদের বদনাম আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে। বিএডিসির উপসহকারী প্রকৌশলী নিজে মাঠ পর্যায়ে কাজ না করে টেকনিশিয়ান দিয়ে কাজ করান তিনি। বিএডিসি প্রত্যয়ন দিতে সাধারণ গ্রাহকদের হয়রানি করে, এমন তথ্য আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত আসে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অফিসে টেকনিশিয়ানকে প্রতিহত করেছি। পরে তাঁরা কোর্টের অনুমোদন নিয়ে এখানে কাজ করছেন।’ তাঁর দাবি, সেচ সংযোগ পেতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মির্জা আজমও।
বিষয়টি জানতে চাওয়া হয় মাদারগঞ্জ উপজেলা সেচ কমিটির সভাপতি ও নির্বাহী কর্মকর্তা ইলিশায় রিছিলের কাছে। তিনি জানান, উপজেলা সেচ কমিটি প্রাপ্ত আবেদন যাচাই-বাচাই করে সভার মাধ্যমে অনুমোদন দেয়। বিদ্যুৎ অফিস ও বিএডিসি তারাই মূলত এ কাজ বাস্তবায়ন করে থাকে। উপজেলা প্রশাসনের নজরে তো মাঠ পর্যায়ের বিষয়টি আসেনি। কেউ অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন