গ্রামের নাম ময়না। নাটোরের লালপুর উপজেলার ওয়ালিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এক গ্রাম। গ্রামটির নাম ময়না কেন হয়েছে– প্রবীণ ব্যক্তিরাও তা তেমন একটা জানাতে পারেননি। ময়নার বুক চিরে বয়ে গেছে চন্দনা নদী। স্নিগ্ধ, সুন্দর, ছবির মতো এই গ্রামটি বারুদের গন্ধ আর রক্তের স্রোতে মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস হয়ে আছে।

এই ময়না গ্রামে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র চার দিনের মাথায় ৩০ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে শত শত মুক্তিকামী মানুষ ছুটে গিয়েছিলেন ময়না গ্রামে। সেই অসম যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা পরাজিত হয়। সাত পাকিস্তানি সেনা নিহতসহ প্রায় অর্ধশত প্রতিরোধকারী শহীদ হন। এই গ্রামের একটি আমগাছ কালের সাক্ষী হিসেবে ‘জীবন্ত স্মৃতিসৌধ’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার চার দিনের মাথায় ৩০ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর একটি রেজিমেন্ট লালপুরের ময়না গ্রামের সৈয়দ আলীর বাড়িতে ঢুকে অবস্থান নেয়। মুক্তিকামী বাঙালিদের কয়েকজন তাদের পিছু নেয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর গুলির মুখে দাঁড়াতে না পেরে ওই যোদ্ধাদের আট যুবক একটি গর্তের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। তবে পাকিস্তানি সেনাদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি তারা। ধরা পড়ে যান। সেনারা তাদের ধরে নিয়ে ময়না গ্রামের ওই আমগাছের সঙ্গে বেঁধে নির্মম নির্যাতনের পর গুলি চালায়। এতে সাতজন শহীদ হন এবং একজন গুলিবিদ্ধ হলেও তিনি বেঁচে যান।

স্বাধীনতার পর আব্দুস সামাদ নামে বেঁচে যাওয়া মানুষটির মুখে সেদিনের ভয়াবহতার গল্প শুনেছেন অনেকেই। জেনেছেন কীভাবে তিনি বেঁচে যান সেদিন। আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ থাকায় গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে আন্দাজ করে লাফিয়ে উঠেছিলেন সামাদ। এতে একটা গুলি তাঁর উরুতে লাগলে  অন্যদের সঙ্গে মরার মতো পড়ে থাকেন। সবার মৃত্যু হয়েছে ভেবে পাকিস্তানি সেনারা তাদের গায়ের ওপর পা মাড়িয়ে ময়না গ্রামের সৈয়দ আলী ও নওয়াব আলী মোল্লার বাড়িতে ঢুকে বাড়িটি দখল করে নেয়। সেনারা বাড়ির মেয়েদের জিম্মি করে। পুরুষ সদস্যরা পালিয়ে বাড়ির পাশের জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। পরে তারা প্রতিরোধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেন। সারাদিন চলে গোলাগুলি। সামাদ দিনভর ওই আমগাছের কাছে মরার মতো পড়ে থাকেন।

পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল ময়না গ্রামে ঢুকে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিকামী বাঙালিরা লাঠিসোঁটা, তীর-ধনুকসহ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে ময়না গ্রামে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলে। শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। এদিকে গুলিবিদ্ধ আব্দুস সামাদ রাতে চারদিক একটু নিস্তব্ধ হয়ে এলে সেখান থেকে পালিয়ে লোকালয়ে যান এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়াসহ তাদের নাজুক পরিস্থিতির খবর মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দেন।

পাকিস্তানি সৈন্যরা থেমে থেমে গুলি করায় আব্দুস সামাদের দেওয়া খবরে নিশ্চিত হন মুক্তিযোদ্ধারা। রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলে আক্রমণ শুরু করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয় এবং সাত সেনাসদস্য নিহত হয়। সেই বীরত্ব ও শোকের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমগাছটি।