
প্রায় দুই দশক ধরে জাপানে আমি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করি। প্রতিবন্ধীদের স্বনির্ভর করে তোলাই আমাদের কাজ। অন্য জাপানিদের সঙ্গে নিয়ে আমি টোকিওতে ‘এসডিসি (সাপোর্ট ফর ডিজঅ্যাবল চিলড্রেন), বাংলাদেশ’ নামে একটি এনপিও (নন প্রফিট অরগানাইজেশন) করেছি বটে, কিন্তু এগোতে পারছি না। যাই হোক, কাজের ব্যস্ততা থাকা ও করোনাভাইরাসের কারণে গত ৩ বছর দেশে যাওয়া হয়নি। শেষে ৫ বছরের মেয়ে জয়তি ও ২ বছরের ছেলে তিহানকে নিয়ে জানুয়ারি মাসের ২৬ তারিখ সপরিবারে দেশে গিয়েছিলাম। মার্চের ১০ তারিখ ফিরে এসেছি।
জয়তির বয়স যখন ১১ মাস, তখন থেকে তাকে নার্সারি স্কুলে দেই। সকাল ৯টায় রেখে এসে বিকেল ৫টায় নিয়ে আসতাম। এখন সে তার স্কুলে যেতে আগ্রহ দেখালেও প্রথম দিকে যেতে চাইতো না। ছোট দুটি হাত দিয়ে এত জোরে গলা জড়ায়ে ধরত যে, ছাড়িয়ে রেখে আসতে কষ্ট হত। দ্রুত হেঁটে ট্রেনে ওঠার পরও শুনতাম পেছনে জয়তি চিৎকার করে কাঁদছে। বিদেশ করা সব সময় সুখের হয় না। মাঝে মধ্যে বড্ড অসহায় মনে হয়। কিন্তু এ পৃথিবীতে নিজেকে আরও বেশি অসহায় মনে হয় ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার পর। কে জানত, জয়তির গলা জড়িয়ে ধরে কান্না গত জানুয়ারির ২৬ তারিখে আমাকে ঢাকা এয়ারপোর্টে আরও একবার শুনতে হবে।
বিদেশে অধিকাংশ বাঙালি পরিবারের ক্ষেত্রে যেটা হয়–ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে সে দেশের ভাষা শিখলেও বাসাবাড়িতে বাংলায় কথা বলে। জয়তিকে আমি একটু গুরুত্ব দিয়েই বাংলা শেখাই। কারণ, আমি নিজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়ালেখা করেছি। গত ৪১ বছর ধরে ডায়েরি লিখছি। আমি চাই মেয়েটা আমার লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে খুঁজে নিক। জয়তি তার মাকে মা বলে ডাকলেও সেই শুরু থেকে আমাকে ‘তাতাচি’ বলে ডাকে।
কেন সে আমাকে তাতাচি ডাকা শুরু করেছিল জানি না। সংশোধন করে দিই না। তবে ভাষার বিবর্তন থেকে যেটা জানি, কাউকে সম্বোধন করে যেটা বলা হয়, প্রথমত সেটা আদল ও উচ্চারিত থেকে আসে।
সংশোধন করা এমন জরুরি কোনো বিষয় না। বছরের শুরুতে দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে জয়তির বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আনন্দ ও উৎসাহ নিয়ে সবাইকে বলতে থাকে আমরা বাংলাদেশে যাব।
দেশ নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করে। যেমন, বাংলাদেশে হোইকুয়েনে (নার্সারি স্কুল) কি ঢ্যাঁড়শ খেতে দেয়? বিগ মিল্ক দেয়? বেশি বেশি ঘুম পাড়ায় (?), ইত্যাদি। বিষয়টা হলো, জাপানে নার্সারি স্কুলে দুপুরে খাবার দেয়। মেন্যুতে ঢ্যাঁরশ থাকলে সে খায় না। স্কুলে ২ বেলা ২ কাপ দুধ খেতে দিলেও সে বেশি খেতে চায়। দুপুরে সবাইকে দুই, আড়াই ঘণ্টা ঘুম পাড়ায়। কিন্তু আরও অনেকের মতো সে সব দিন ঘুমায় না। খেলতে চায়।
এমন অনেক প্রশ্ন, উত্তর দিয়ে পারি না। আমরা যেমন বরাবরই বাংলাদেশ নিয়ে তাকে সুন্দর স্বপ্ন দেখাই। বুঝতে পারি, জয়তি নিজেও বাংলাদেশ নিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখে। জাপানি ছেলেমেয়েদের আঁকা পতাকার সাদা অংশ জয়তির কালিতে সবুজ হয়ে ওঠে। বয়স ২ বছর হোক, অথবা ৫ বছর, কেউ যখন বাপ-মা’র সঙ্গে শহর থেকে গ্রামে অথবা বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে যায়, তখন শুধু লাগেজের ওপরে উঠে খেলা করা নয়। বরং লাগেজের ভেতরেও এটা সেটা ঢোকাতে চেষ্টা করে।
ঢাকা এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে নামার পর প্রথম সমস্যা হলো, প্লেন ভেড়ার পরও প্রকট শব্দ শোনা যায়। প্লেন থামার আগেই লোকজন সবাই তাড়াহুড়া করে নামার চেষ্টা করে। এয়ারপোর্টে আলো যথেষ্ট নয়। গেটের কাছে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে থাকে। একাধিকবার তিক্ত অভিজ্ঞতার পর টেনশনে থাকতে হয় জিনিসপত্র অক্ষত অবস্থায় ঠিক মতো পাব কিনা? লোকজনের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি ও হাঁকডাকতো আছেই। এ সব দেখে সে দিন (জানুয়ারি ২৬) জয়তি খুব ভয় পায়। কোলে উঠে আর নামতে চায় না। কিন্তু যখন একটা লোক আচমকা আমার কাছে এসে নিচু স্বরে কথা বলে, মেয়েটা তখন আরও ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলে। বুকে ইমিগ্রেশন লেখা লোকটা আমাকে বলছিল, ছোট ছেলেমেয়ে আছে আগে যেতে চাই কিনা? টোকিওর বাসা থেকে সেই সকাল ৬টায় রওনা হয়েছি, এখন রাত সাড়ে ১০টা বাজে। বলি হাঁ, যেতে পারলে তো ভালোই। আমি মনে করেছিলাম অন্য সব এয়ারপোর্টে ছোট ছেলেমেয়ে থাকলে, বৃদ্ধ বা প্রতিবন্ধী লোক থাকলে যেভাবে আগে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়, বোধ হয় ইমিগ্রেশনের লোকটি তেমন কিছু করতে চাইছেন। তিনি আমাকে পাসপোর্ট দিতে বলেন। আমি ৪টা পাসপোর্ট তার হাতে দেওয়ার পর ভদ্রলোক যে কাউন্টারে দেন সেখানে কোনো সার্ভার ছিল না। অনেকক্ষণ পর অন্য কাউন্টারে দেন। কাউন্টারের লোকটি বলছিলেন বাড়ি ফরিদপুর কোথায়? বলার পর কাজটি দ্রুত সম্পন্ন হলেও আমার ইমিগ্রেশন যখন শেষ হয় তখন পেছনে তেমন লোকজন ছিল না। শেষে ইমিগ্রেশনের ওই লোক কাউন্টারের সামনেই আমার একদম গা ঘেষে দাঁড়ান ও পারলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেন, যা দেখে জয়তি আরও জোরে কেঁদে ওঠে। আমি তড়িঘড়ি করে কাছে থাকা টাকা থেকে তাকে ৫শ’ টাকা দিই।
এয়ারপোর্টে ট্রলি ও বুকিং-এ দেওয়া জিনিসপত্র পেতে সমস্যা হয়। পরনের কাপড় ও ইউনিফর্ম দেখে মনে হয় তারা এয়ারপোর্টের কোনো না কোনো শাখায় কাজ করেন। অথচ সবাই কিছু একটা ধান্দা নিয়ে কাছে আসেন। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে বাংলাদেশের ঢাকা এয়ারপোর্টের লোকজনের সেবা ও আচরণ নিয়ে কিছু বলতে চাইলে বাংলা ভাষায় ‘অ’ দিয়ে শুরু হওয়া শব্দ আর থাকে না। যাই হোক, বাইরে যোগাযোগ করতে এবং গাড়ি খুঁজে পেতে এক আনসারভাই আমাকে কিছুটা সাহায্য করেন ঠিকই, কিন্তু অনিশ্চয়তা ও চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে অনেক সময় কেটে যায়। স্ত্রী ও ছোট দুটি ছেলেমেয়ের কাছে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। এয়ারপোর্টের মধ্যে থাকা পুরো সময় জয়তি এক মুহূর্তের জন্যও আমার কোল থেকে নামে না।
কান্না থামায় না। তাকে কোলে করেই আমার সব কাজ করতে হয়। এবং সারাক্ষণ চোখেমুখে আতঙ্ক ও কান্নারত অবস্থায় সে আমাকে বার বার বলতে থাকে, ‘তাতাচি আমি এখানে থাকব না। আমি বাংলাদেশে যাব।’
মো. মোতাহের হোসেন: গবেষক
মন্তব্য করুন