- খেলা
- ধু-ধু গ্যালারি, দর্শক আনতে উদাসীন ক্লাব
ধু-ধু গ্যালারি, দর্শক আনতে উদাসীন ক্লাব

ম্যাচের দিন ভেন্যু দেখে অবাক হয়েছেন বেশ কয়েকটি ক্লাবের কর্মকর্তা। ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা প্রিমিয়ার লিগ অথচ গোপালগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের ভেন্যুতে তার কোনো রেশ নেই। এ দুই ভেন্যুতে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে গিয়ে এক ক্লাবের কর্মকর্তা বুঝতেই পারছিলেন না, তাঁদের খেলা এ মাঠেই কিনা। নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাফুফের পাঠানো ফিকশ্চার দেখতে হয়েছে তাঁকে। যেখানে ক্লাবগুলোই ভেন্যুতে গিয়ে দোটানায় পড়ে যায় নিজেদের খেলা আছে কিনা, সেখানে দর্শকের অন্ধকারে থাকাটাই স্বাভাবিক। ক্লাবগুলো ঢাকা থেকে দু’দিনের জন্য পিকনিক মুডে মফস্বলে দলবল নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মফস্বলের যে শহরে খেলা, সেখানকার দর্শকের সঙ্গে কোনো ক্লাব বন্ধন তৈরি করতে পেরেছে কি? স্থানীয় স্কুলে গিয়ে কেউ ছাত্রছাত্রীদের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ দেখার আমন্ত্রণ করেছে কি? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন সাখাওয়াত হোসেন জয়।
ঢাকার বাইরে খেলার উদ্দেশ্য এবং সার্থকতা
ঢাকার মাঠে দর্শক খরা দীর্ঘদিনের। সে জন্য ফুটবলে দর্শক ফেরাতে জেলা শহরগুলোতে ঘরোয়া প্রতিযোগিতার খেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় বাফুফে পেশাদার লিগ কমিটি। প্রিমিয়ার লিগের এবারের মৌসুম শেষ পর্যায়ে এসে গেলেও ঢাকার বাইরে প্রত্যাশা অনুযায়ী দর্শকের দেখা মেলেনি। স্বাগতিক ক্লাবগুলোর উদাসীনতা এবং বাফুফে ঠিকমতো তদারকি না করায় দর্শকের জোয়ার চোখে পড়েনি। কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম আবাহনী ও মোহামেডানের হোম ভেন্যু। মুন্সীগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহের চেয়ে সেখানে দর্শকের উপস্থিতি বেশি ছিল। তার পরও ঢাকার বাইরে যে উদ্দেশ্যে খেলা নিয়েছে বাফুফে, তা যে পুরোপুরি পূরণ হয়নি, সেটা ক্লাব কর্তারাই স্বীকার করেছেন। তবে অনেকাংশে সার্থক হয়েছেন বলে মনে করেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের টিম লিডার আবু হাসান চৌধুরী প্রিন্স, ‘দর্শকের জন্য লিগের খেলা শুক্রবার-শনিবার দিয়েছে। কিন্তু অনেকে জানে না কবে খেলা। ফুটবল ফেডারেশন যদি একটু সোচ্চার হয়, তাহলে দর্শক আসবে। টিভিতে বিজ্ঞাপনও দিলে দর্শক মাঠে আসবে। ফেডারেশন যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে, তাহলে ফুটবল আরও অনেক এগিয়ে যাবে। আমি মনে করি, মোটামুটি সার্থক হয়েছে। বাইরের লোকগুলো আসতে পারে।’ আবাহনী ম্যানেজার সত্যজিৎ দাস রুপুর কথাতে মনে হয়েছে, মাঠে দর্শক ফেরানোর দায়িত্ব মিডিয়ার, ‘আপনারা বড় বড় করে লেখেন, হেডলাইন দেন, তা দেখে দর্শক তো মাঠে আসবে। যেখানে খেলতে হচ্ছে, দল হিসেবে আমরা সেখানে যাচ্ছি। সার্থকতা বিচার করার দায়িত্ব আপনাদের মিডিয়ার।’
প্রচারণার দায়িত্ব ক্লাবগুলোর, কিন্তু...
নতুন মৌসুম এলেই দেশি-বিদেশি ফুটবলারদের দলে ভেড়ানোর জন্য কোটি কোটি টাকা নিয়ে বসে থাকে ক্লাবগুলো। প্রিমিয়ার লিগের এক মৌসুম চালাতে বড় ক্লাবগুলোর ১৫ থেকে ২০ এবং ছোট ক্লাবগুলোর খরচ হয় ৭-১০ কোটি টাকা। খেলোয়াড় টানতে কোটি কোটি টাকা লগ্নি করলেও মাঠে দর্শক ফেরানোর ব্যাপারে উদাসীন তারা। প্রতি মৌসুমেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন থেকে বলে দেওয়া হয়, দর্শক মাঠে আনার পুরো প্রক্রিয়াটি হোম ভেন্যু যাদের, সেই ক্লাবগুলোর। সেই অনুযায়ী স্টেডিয়ামে ব্যানার, লিফলেট থেকে শুরু করে সবকিছু সাজানোর দায়িত্ব স্বাগতিক ক্লাবের। ম্যাচের দিন যাতে দর্শক মাঠে আসে, সে জন্য মাইকিং থেকে শুরু করে জেলা শহরের বিভিন্ন জায়গায় তোরণ লাগানোর কথাও সংশ্লিষ্ট ক্লাবের। ইউরোপিয়ান ফুটবলের ক্লাবগুলো যেভাবে তাদের সমর্থকদের জন্য নানা কিছু করে থাকে, সেখানে বাংলাদেশের ফুটবলে হাতেগোনা কয়েকটি ক্লাব ছাড়া আর কেউই দর্শকদের জন্য বিশেষ কিছুর ব্যবস্থা করেনি। ঐতিহ্যের দিক থেকে আবাহনী আর মোহামেডানের একটা ফ্যান বেজ আছে। তাদের ম্যাচের দিন দর্শকের সাড়া পাওয়া গেলেও অতীতের মতো নয়। মোহামেডানের যেমন ‘মোহাপাগল’ নামে সমর্থকগোষ্ঠী এবং মোহামেডান সমর্থক দল আছে। তারাই ম্যাচের দিন দলবেঁধে গ্যালারিতে আসেন। আর আবাহনীরও সমর্থকগোষ্ঠী আছে। প্রিমিয়ার লিগে আবির্ভাবের পর বসুন্ধরা কিংস তৈরি করেছে সমর্থকগোষ্ঠী। যারা কিনা প্রতিটি ম্যাচে নিজ ক্লাবের জার্সি পরে মাঠে গিয়ে দলকে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন। শুধু টি-শার্টই নয়, সমর্থকদের এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে নিয়ে যাওয়া, তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা পর্যন্ত করছে বসুন্ধরা কিংস। দর্শক যাতে মাঠে আসেন, তাই সমর্থকদের জন্য এসব করতে দ্বিধা করছেন না আবাহনী ও মোহামেডান কর্তারা।
তাদের সঙ্গে নবাগত ফর্টিস ফুটবল ক্লাবও দর্শকদের জন্য নিজেদের হোম ভেন্যু রাজশাহীতে টি-শার্ট দেওয়াসহ খাবারেরও ব্যবস্থা করে আসছে। রাজশাহীর ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড়দের মাঠে আনার জন্য সেখানে গিয়েছেন কর্মকর্তারা। এত কিছু করার পরও মাঠে প্রত্যাশা অনুযায়ী দর্শক না আসায় আফসোস ফর্টিস এফসি ক্লাবের ম্যানেজার রাশেদুল ইসলামের। সমকালের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাচের দিন দর্শকদের জন্য টি-শার্টের ব্যবস্থা করেছি। একাডেমির ফুটবলারদের মাঠে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছি। কিন্তু আরও ভালো হতো যদি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গিয়ে বলতে পারতাম। তাহলে এই প্রজন্মও দেশের ফুটবলের প্রতি আরও আকৃষ্ট হতো।’
এই চারটি ক্লাবের বাইরে বাকি সাতটি ক্লাব– শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব, পুলিশ এফসি, উত্তর বারিধারা, চট্টগ্রাম আবাহনী, রহমতগঞ্জ এমএফএস ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র তাদের হোম ভেন্যুতে দর্শক ফেরানোর তেমন উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি কোনো সমর্থকগোষ্ঠীও নেই তাদের। এ জন্য নিজেদের ব্যর্থতাকে সামনে এনেছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবের ম্যানেজার আরিফুল ইসলাম। তাঁর দাবি প্রচারণার দায়িত্ব নাকি ক্লাবের নয়, বাফুফের, ‘আমরা আগে প্রচারণা করেছি; কিন্তু এবার সেটা করছি না। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের করার কথা।’ কিন্তু বাফুফে তো মাঠ ঠিক করে দিয়েছে, প্রচারণা তো আপনাদের? ‘যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে এটার ব্যর্থতা আমাদেরই। আসলে আমরা আরেকটু দায়িত্ব নিয়ে করলে দর্শক মাঠে আসত।’ সেটা করেননি কেন? ‘নানান সীমাবদ্ধতা আছে আমাদের। আর্থিক বিষয়গুলো তো আছে।’ মুক্তিযোদ্ধার ম্যানেজারের মতো একই সুর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ এফসির এক কর্মকর্তার, ‘আসলে ফুটবলের প্রচারণার দায়িত্ব ক্লাবের। কিন্তু ফাইন্যান্সিয়াল সমস্যার কারণে টি-শার্ট গিফট করা, পানি এবং খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। এগুলো করলে ছোট ছোট বাচ্চারা মাঠে আসত। ছোট ক্লাব হওয়ায় দলবদলে প্রথম ধাপে সাইনিং করতে গিয়ে অনেক টাকা চলে যায়। এর পর দর্শকদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করার মতো অর্থ থাকে না।’
মাঠ সংস্কার করেই দায়িত্ব শেষ বাফুফের
ঘরোয়া ফুটবল প্রতিযোগিতার জন্য আছে বাফুফে পেশাদার লিগ কমিটি। প্রতিটি মৌসুমে ভেন্যু চূড়ান্ত করাসহ নানা কাজ করে থাকে তারা। এর মধ্যে ক্লাবগুলোক মাঠ বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্তাদের। শুধু ভেন্যু চূড়ান্ত করেই নয়, খেলার উপযোগী করতে যা যা করা দরকার তা করার দায়িত্ব লিগ কমিটির। মাঠ সংস্কার করে ক্লাবগুলোকে বুঝিয়ে দিলেও সংস্কারের অর্থ নিজেদের ফান্ড থেকে ব্যয় করতে হয় না তাদের। পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে যে অর্থ আসে, তার থেকে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা পার্টিসিপেশন মানি হিসেবে ক্লাবগুলোকে দেওয়ার কথা। বেশিরভাগ সময়ই এক মৌসুমের অংশগ্রহণ ফি পরের মৌসুমে দিয়ে থাকে লিগ কমিটি। আর মাঠ সংস্কারের টাকাটা তারা ক্লাবগুলোর পার্টিসিপেশন মানি থেকে কর্তন করে নেয়। প্রচারণার দায়িত্বটা কাঁধে তুলে দেয় ক্লাবগুলোর ওপর। যেসব ক্লাবের হোম ভেন্যু, সেসব ক্লাব মাঠে দর্শক ফেরানোর জন্য কোনো উদ্যোগ নেয় কিনা, তা নিয়ে তদারকি করে না ফেডারেশন। শুধু মাঠ সংস্কার করেই দায়িত্ব শেষ বাফুফের।
টিকিট নেই তা জানে না অনেকে
ফেডারেশন কাপ কিংবা স্বাধীনতা কাপ; টুর্নামেন্টগুলোতে দর্শকদের জন্য আলাদা টিকিটের ব্যবস্থা করে আসছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। এ প্রতিযোগিতাগুলোর আগে টিকিটের মূল্যও নির্ধারণ করে দেয় বাফুফে। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে ম্যাচের টিকিট নেই! বিষয়টি আশ্চর্যজনক হলেও সত্য। বাফুফে থেকে বলে দেওয়া হয়েছে দর্শক মাঠে ফেরানো এবং অন্য বিষয়গুলো দেখবে হোম ভেন্যুর ক্লাবগুলো। কিন্তু এবারের লিগে কোনো ম্যাচেই টিকিটের ব্যবস্থা করেনি স্বাগতিক ক্লাবগুলো। তাদের কথা, টিকিট ছাপানোর দায়িত্ব নাকি বাফুফের। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমপিটিশন ম্যানেজার জাবের বিন তাহের আনসারি বলেন, ‘টিকিট ছাপানোর বিষয়গুলো হোম ক্লাবের। আর এগুলো দেখভাল করে মার্কেটিং বিভাগ।’ টিকিট ছাপানো হয়েছে কিনা, তা জানতে বাফুফে মার্কেটিং বিভাগের প্রধান এ টি এম তারেককে ফোন দিলে, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাননি।
অন্তত মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করা যায়
প্রিমিয়ার লিগে যে কিছু সংখ্যক দর্শক মাঠে আসেন, তা আবাহনী, মোহামেডান, বসুন্ধরা, ফর্টিস এফসির মতো ক্লাবগুলোর উদ্যোগের কারণে। বাকি ক্লাবগুলো দর্শক ফেরানোর জন্য সেই অর্থে কাজ করছে না। অন্তত ম্যাচের আগের দিন শহরজুড়ে মাইকিংয়ের ব্যবস্থাটুকুতো তারা করতে পারেন। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। এর জন্য খুব বেশী কি অর্থের প্রয়োজন? যদিও আর্থিক সংকটকে দায়ী করেছেন বেশ কয়েকটি ক্লাবের কর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্লাবের কর্মকর্তা, ‘ফুটবলের যে অবস্থা, এখন টিকিট দিলে তো আরও দর্শক আসবে না। কারণ হলো ফুটবল ফেডারেশন থেকে অনেক মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যদি ফেডারেশন থেকে কিছু প্রণোদনা দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি ক্লাব দর্শকদের আনতে উদ্যোগ নেবে। অন্তত টি-শার্টের ব্যবস্থা করলেও দর্শকরা মাঠমুখী হবে।’
অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন না ফুটবলাররা
সবুজ গালিচায় ইউরোপিয়ান ফুটবলের মতো গোল করছেন ফুটবলাররা অথচ তা দেখার লোক নেই। ঢাকার বাইরে খেলা হলেও ঘরোয়া ফুটবলে মাঠে দর্শক সেভাবে আসছে না। ফাঁকা গ্যালারিতে খেলা হওয়ায় ফুটবলাররা উপভোগ করছেন না মাঠের লড়াই। যাঁদের সমর্থনে ভালো ফুটবল খেলবেন, সেই দর্শকের উপস্থিতি কম হওয়ায় হতাশ শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের মিডফিল্ডার এবং জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া, ‘ইউরোপিয়ান ফুটবলে গ্যালারি পরিপূর্ণ থাকে। দর্শকের সামনে ফুটবলাররা নিজেদের উজাড় করে দেন। কিন্তু খারাপ লাগে আমাদের দেশে সেই পরিমাণ দর্শক দেখা যায় না।’ ফর্টিস এফসির আফগান তারকা আমিরুদ্দিন শরীফিরও মন খারাপ, ‘দর্শক নেই বলে কিছুটা খারাপ তো লাগেই। তবে যদি মিডিয়াতে ভালোভাবে প্রচার হয়, তাহলে স্টেডিয়ামমুখী হবেন দর্শকরা। তাঁরা জানেন না কবে খেলা, সেটা তাঁরা জানলে মাঠে আসতেন।’
মন্তব্য করুন