ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে পরিবহন যোগাযোগ নির্বিঘ্ন হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আরও ২ শতাংশ বাড়বে। বিনিয়োগে বিদেশি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়বে। যানজটকে এখন তাঁরা বিনিয়োগের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এ বাস্তবতায় ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

শনিবার অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগবিষয়ক এক গোলটেবিল আলোচনায় এমন দাবি করেন তাঁরা। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি) রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে এর আয়োজন করে। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন। সভা সঞ্চালনা করেন আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, যোগাযোগ নির্বিঘ্ন করতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দরকার। তবে এ বিষয়ে আরও ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করবেন তিনি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে রেল যোগাযোগ উন্নয়নে সরকারের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন তিনি।

আলোচনায় উন্নয়ন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের মাহাথির’ হিসেবে উল্লেখ করেন এম এ মান্নান। তিনি বলেন, মাহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ায় যে পরিস্থিতিতে উন্নয়ন শুরু হয়, সে তুলনায় অনেক খারাপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে উন্নয়ন শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের অধ্যাপক এবং অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ড. শামসুল হক। তিনি বলেন, অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগ সত্ত্বেও যোগাযোগ খাতে যথেষ্ট উন্নতি হয়নি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পরিবহনের গতি থাকার কথা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার, যা বর্তমানে গড়ে ৩০ কিলোমিটার। ধীরগতির কারণে পণ্য উৎপাদন ব্যয় বেশি হয় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। রপ্তানি খাতের সামর্থ্যের চেয়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ রপ্তানি কম হচ্ছে। এ মহাসড়কে যানজটের জন্য কয়েকটি কারণের মধ্যে রয়েছে ৬৫টি হাটবাজার, অযান্ত্রিক যান চলাচল, অননুমোদিত ভারী যান চলাচল ও যোগাযোগ খাতে নীতি সমন্বয়হীনতা। সমাধান হিসেবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং স্বতন্ত্র একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভুল উন্নয়ন নীতির কারণে একসময় সারাদেশে নিচু সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এসব সেতুর নিচ দিয়ে নৌপরিবহন তো দূরে থাক, পানিও আসা-যাওয়া করতে পারেনি। যোগাযোগ খাতে পরিকল্পনায় আরও সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি।

আইসিসিবির সভাপতি বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে পরিবহন যোগাযোগের চাপ বাড়ছে। তবে চার লেনের মহাসড়কের এ চাপ নেওয়া সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম বন্দর, মাতারবাড়ী অর্থনৈতিক কেন্দ্রসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর সুবিধা কাজে লাগাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রয়োজন। এ এক্সপ্রেসওয়ের সারাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল, ভুটানসহ এশিয়ান হাইওয়ের মধ্যে কার্যকর এবং মসৃণ সংযোগ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। রপ্তানি বাণিজ্যে সরকারের বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে এ ধরনের অবকাঠামোর প্রয়োজন রয়েছে।

আইসিসিবির সহসভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, রপ্তানি এবং কর্মসংস্থান কমছে। আগামী ২০২৫ সালের আগে পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা নেই। যেসব প্রকল্পের নির্মাণকাজ ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে, সেগুলো শেষ করা এবং অত্যাবশ্যক হলে নতুন প্রকল্প নিতে হবে। তিনি বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাবে হংকং কিংবা সিঙ্গাপুর হয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠাতে হয়। শুধু এ কারণে প্রতিটি চালানে অতিরিক্ত ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে, যা পশ্চিমা ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ভুল ব্যবস্থাপনায় চলছে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন। তিনিও ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের দাবি করেন।

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অনেক বাধা আসে। কাস্টমস বা শুল্ক বিভাগকে পৃথিবীর সবচেয়ে অদক্ষ কাস্টমস বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার সামির এ সাত্তার লজিস্টিকের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি জানান। সংগঠনের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে পরিবহন যোগাযোগ নির্বিঘ্ন হলে উৎপাদন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে রাজধানীর ওপর বর্তমানে যে অস্বাভাবিক চাপ রয়েছে, তা অনেকটাই কমবে।

আরও বক্তব্য দেন বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরি, ঢাকা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার, উত্তরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।