
ছোটবেলায় স্কুলে সব ধরনের খেলাধুলা করতেন। নারী শুটারের খোঁজে একদিন একটি চিঠি এসেছিল বিদ্যালয়ে। খেলাধুলাপাগল আনজিলা আমজাদ না বুঝেই নাম দিয়ে ফেলেছিলেন। যে খেলা সম্পর্কে ধারণা নেই, সেই খেলাটা কীভাবে খেলবেন, তা নিয়ে চিন্তা তাঁর। বাবা মোহাম্মদ আমজাদ হোসেনই হাতে-কলমে মেয়েকে শুটিংয়ের শিক্ষা দেন। কীভাবে পিস্তল ধরতে হবে, মারতে হবে কীভাবে– সবকিছুই বাবার কাছ থেকে শিখেছেন। একসময় শুটিং না বোঝা আনজিলাই এখন বাংলাদেশের শুটিংয়ের অন্যতম তারকা। চীনের হ্যাংঝুতে অনুষ্ঠেয় এশিয়ান গেমসেই নয়, পদকের স্বপ্ন দেখছেন অলিম্পিকের মতো আসরে। শুটিং নিয়ে আনজিলা আমজাদের স্বপ্নের কথাগুলো শুনেছেন সাখাওয়াত হোসেন জয়
সমকাল : প্রথমবার এশিয়ান গেমসে যাচ্ছেন, অনুভূতিটা একটু বলেন?
আনজিলা : অনুভূতি তো অনেক ভালো। আলহামদুল্লিল্লাহ স্কোর আগে থেকেও ভালো হচ্ছে। চেষ্টা করব নিজের সেরাটা দেওয়ার। এখন দেখা যাক কী হয়। এতদিন ধরে সিনিয়রদের কাছ থেকে এশিয়ান গেমসের অনেক গল্প শুনেছি। অনেক বেশি মজা হয়। অনেক বেশি প্লেয়ার থাকে। ভালো খেলার সুযোগ থাকে। সব পজিটিভ দিকই শুনে এসেছি। এখন দেখা যাক আমি কি কি দেখি। এতদিন শুনেছি এবার নিজের চোখে সেগুলো দেখব। বিষয়টি অন্যরকম লাগছে।
সমকাল : প্রথমবারের মতো এশিয়াডে খেলতে যাচ্ছেন বলে কোনো চাপ অনুভব করছেন কিনা?
আনজিলা : একটু তো চাপ থাকেই। এটা যে কোনো গেমসের জন্য। দেশের বাইরে খেলতে যাওয়া মানেই একটা প্রেশার। চেষ্টা করব চাপটা কাটিয়ে ওঠার জন্য।
সমকাল : শুটিং এমন একটি খেলা, যেখানে স্নায়ুর চাপ ধরে রাখাটাও চ্যালেঞ্জ। মনোবল ধরে রাখতে সম্প্রতি আপনাদের জন্য মনোবিদ এনেছিল ফেডারেশন।
আনজিলা: আগে থেকে অনেক ভালো অবস্থায় আছি আমরা। আসলে গেমসের ওই সময়ে মনোযোগ অনেক বেশি থাকতে হয়। একটু উনিশ-বিশ হলে আমাদের শর্টটা অনেক দূরে চলে যায়। আর ফেডারেশন যে মনোবিদ এনে আমাদের সেশন করিয়েছে, এটা খুবই কাজে এসেছে। আমরা বুঝেত পেরেছি কোনো সময় মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলে কীভাবে ওভারকাম করতে পারব। আর আমরা অনেকক্ষণ কীভাবে মনোযোগ ধরে রাখতে পারব এগুলো ছিল ওই সেশনে। ওটা আমাদের জন্য অনেক ভালো হয়েছে।
সমকাল : আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে অনেক পদক এনে দিয়েছিলেন শুটাররা। ব্যক্তিগতভাবে এশিয়াডে আপনার লক্ষ্য কী?
আনজিলা: ব্যক্তিগতভাবে সবাই চাইবে যেন স্বর্ণ জিততে পারে। প্রত্যেক শুটারই চেষ্টা করেন ফাইনাল খেলতে। আমিও সেই চিন্তা করব যেন ফাইনালে স্বর্ণের লড়াইয়ে অংশ নিতে পারি। অবশ্যই আমি এশিয়াডে পদকের স্বপ্ন দেখছি।
সমকাল: পড়াশোনা ও খেলাধুলা একসঙ্গে চালাতে কতটা কঠিন?
আনজিলা: আমি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স শেষ বর্ষে পড়ছি। এর সঙ্গে কিন্তু আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বিবিএও করছি। এআইইউবির বিষয়টি হচ্ছে, ওরা অনেক সাপোর্ট দিচ্ছে। শিক্ষকরা সাপোর্ট না দিলে আমরা পারতাম না। তার পরও দুটি একসঙ্গে চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। সারাবছর দেখা যায় ক্যাম্পে থাকতে হয়। যে কারণে অনার্সে যতটুকু পড়ার প্রয়োজন, আমরা সেটা পড়তে পারছি না। সারাদিন প্র্যাকটিস করার পর রাতে পড়ার শক্তিটাও থাকে না। তার পরও দুটি বিষয় যেন চালাতে পারি, সেই চেষ্টা করি।
সমকাল : সম্প্রতি শুটিংয়ে সাফল্য খুব কম আসছে। নতুন করে ফেডারেশন আপনাদের জন্য কী পরিকল্পনা করছে?
আনজিলা: আগে থেকে ফেডারেশন আমাদের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত। সভাপতি পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে বসছেন, আমাদের কী লাগবে, সবকিছুই তারা ভালোভাবে দেখছেন।
সমকাল: কোনো একটি প্রতিযোগিতা এলে ভারতের ফেডারেশন তাদের শুটারদের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে তো এমনটা হচ্ছে না।
আনজিলা : হচ্ছে না ঠিক, তবে আমাদের ফেডারেশন এ কাজটি করার জন্য অনেক চেষ্টা করছে। আমাদের যে বিদেশি কোচ আছেন, তিনি অনেকভাবে ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন যেন বাইরে ট্রেনিং ক্যাম্প করানো হয়। বাইরে গিয়ে ট্রেনিং করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেখানে অনেক নতুন জিনিস শেখায়, যেগুলো হয়তো আমরা বাংলাদেশে থাকলে সেভাবে শিখতে পারব না। এজন্য ফেডারেশন চেষ্টা করছে আমরা যেন বাইরের দেশে গিয়ে ট্রেনিং করতে পারি। এবার তো হয়নি। আশা করি, সামনে হবে। ভারতের যা আছে, আমাদের তা নেই এটা ঠিক। তবে যতটুকু আছে, তা নিয়ে ফাইট দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে।
সমকাল: শুটিংকে ঘিরে আপনার স্বপ্ন কী?
আনজিলা: অবশ্যই স্বপ্নটা অলিম্পিক খেলার। আমার জন্য যেন অন্য দেশ জানতে পারে, এটা বাংলাদেশের পতাকা। এমনভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চাই, যেন প্রত্যেকটি মানুষ বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পারে। অলিম্পিকে খেলার সঙ্গে সেখান থেকে পদক নেওয়ারও স্বপ্ন আছে।
সমকাল : কোনো একদিন সংসার জীবনে জড়াতে হবে। হয়তো শুটিং ছাড়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন?
আনজিলা : আমি এমন জিনিস দেখেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করব, যেখানে আমার শুটিংটাকে সবাই গ্রহণ করে নেবে, যেন কোনো সমস্যা না হয়।
সমকাল : তাহলে শুটিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেবেন?
আনজিলা: সম্পৃক্ত হোক বা না হোক, যেন আমাকে শুটিংয়ে অনেক সাপোর্ট করে।
সমকাল : সবার সাপোর্ট পাচ্ছেন। তার পরও কি শুটিং নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে?
আনজিলা : আক্ষেপ বলতে আমাদের অনেক প্র্যাকটিস দরকার। যখন গেমস থাকে, তখন ক্যাম্প করি। আর যখন গেমস থাকে না, তখন ক্যাম্প করতে পারি না। যারা গেমসে অংশ নেন, তারা কিন্তু সারাবছরই ক্যাম্পে পড়ে থাকেন। আমাদের গুলি থাকে না, রাইফেল-পিস্তলে সমস্যা। এই সমস্যাগুলো লেগেই থাকে। আপনি জানেন, কয়েকদিন আগে আমাদের গুলি এসেছে, প্রথমে ঠিকমতো মারতে পারতাম না। সামনে গেমস, আমরা যদি এখনও এ রকম করি, তাহলে কীভাবে ফাইনালে উঠবে। তাই আমার চাওয়া, আমরা যেন সব সময় ক্যাম্পে থাকি, প্র্যাকটিস করি। এই জিনিসগুলো ঠিক থাকলে মনোযোগটাও বাড়ে। এশিয়ান গেমসের আগে আমরা ছয় মাস ক্যাম্প করেছি। বাইরের দেশের দিকে তাকালে দেখবেন, ওরা অনেক আগেই ট্রেনিং শুরু করেছে। আমার যতটুকু ধারণা, সময়টা কম হয়ে গেছে। আরও আগে থেকে ট্রেনিং শুরু করলে ভালো হতো। তাহলে এখন যে স্কোরটা আমি করছি, তার চেয়ে আরও বেশি করতে পারতাম।
মন্তব্য করুন