ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

অপুর ‘চক্রে’ বন্দি শুটিং

অপুর ‘চক্রে’ বন্দি শুটিং

শুটিং ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুল অপু (বাঁয়ে) ও শুটার শাকিল।

সাখাওয়াত হোসেন জয়

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪ | ১৫:২০

অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই শুটারদের ওপর আসে নিষেধাজ্ঞার খড়্গ। ক্যাম্প থেকে বহিষ্কার করার সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া বন্ধ। মিষ্টভাষী, সব অন্যায় মেনে নেওয়া শুটাররা হয়ে যান মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর আস্থাভাজন! এই আস্থাভাজন খেলোয়াড়রা বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের মহাসচিবের সব অপকর্মের সহায়তাকারী। তাদের সঙ্গে আছেন ফেডারেশনের দুই কর্মকর্তা।

শুটিংয়ের গুলি নিয়ে নয়ছয় করার অভিযোগ সহকারী কোচ গোলাম মহিউদ্দিন শিপলুর বিরুদ্ধে। অপুর আশকারায় বাজেটের হিসাবে গরমিল করে ম্যানেজার দেবাশীষ বিশ্বাসও ফেডারেশন থেকে টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। সরকার পতনের পর ইন্তেখাবুল হামিদ অপু পালিয়ে বিদেশে চলে গেলেও তাঁর অনুপস্থিতিতে ফেডারেশন সামলাচ্ছেন শিপলু, দেবাশীষের সঙ্গে কয়েকজন শুটার।

গত এক যুগ ফেডারেশনের মহাসচিবের চেয়ারে বসা অপু এদের নিয়ে একটা চক্র গড়ে তুলেছেন। তাঁর কথায়ই শুটিংয়ে শেষ কথা ছিল। বড় ভাই সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ছায়াতলে থাকা ছোট ভাই অপু রীতিমতো স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলেন ফেডারেশনে। অপুর স্বৈরাচারী আচরণের কারণে এতদিন মুখ বুজে সব সহ্য করেছিলেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে পদক এনে দেওয়া বঞ্চিত শুটাররা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আস্তে আস্তে মুখ খুলতে শুরু করেছেন তারা।

ফেডারেশনকে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানানোর সঙ্গে নিজের কথা যারা শুনত, সেই শুটারদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনা ইভেন্টকে ডুবিয়েছেন বলে সমকালের সঙ্গে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শুটার। সিঙ্গাপুর থেকে ফোনে নিজের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইন্তেখাবুল হামিদ অপু। 

দুর্নীতি, অনিয়মের সঙ্গে অপুর বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ স্বজনপ্রীতির। ২০১৮ সালে প্রতিভাবান শুটারকে বাদ দিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিজের মেয়ে আমিরা হামিদকে পাঠানো হয়েছিল বুয়েন্স আয়ার্সে যুব অলিম্পিকে। সেখানে বাছাই পর্বে মাত্র ৬০৯ স্কোর করে ১৭তম হয়ে বাদ পড়েছিলেন তাঁর মেয়ে। শুধু তাই নয়, সর্বশেষ হওয়া বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমসে স্কোর দৃশ্যমান বলে ১০ মিটারে তাঁর মেয়েকে খেলাননি অপু। ৫০ মিটারে দূরে মারতে হয় আর অফিসিয়াল স্কোর গুনে এনে পরে প্রকাশ করেন। দুর্নীতি করে তাঁর মেয়েকে প্রথম বানানোর অভিযোগ আছে অপুর বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক গেমসে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দল গঠন না করার অভিযোগ আছে অপুর বিরুদ্ধে। এই কাজে তিনি ব্যবহার করেন সহকারী কোচ শিপলুকে। 

প্যারিস অলিম্পিকের বাছাইয়ের জন্য ব্রাজিল, স্পেন এবং জার্মানিতে হয়েছিল শুটিংয়ের বাছাই পর্ব। মূলত অলিম্পিকের স্কলারশিপে যাদের নাম থাকে, যে কোনো ফেডারেশন ওই অ্যাথলেটকে পাঠাতে বাধ্য থাকে। কিন্তু শুটিং ফেডারেশনের মধ্যে স্কলারশিপে শায়েরা আরেফিন এবং কামরুন নাহার কলির নাম ছিল। অথচ শায়েরাকে এই তিনটি গেমসে পাঠালেও কলিকে পাঠানো হয়নি। কিন্তু কেউই সরাসরি অলিম্পিকের টিকিট কাটতে পারেননি। 

এই বিষয়টি নজরে আনলে সহকারী কোচ শিপলুর দাবি, যার স্কোর বেশি তাঁকেই প্রতিযোগিতায় পাঠানো হয়েছে। অথচ জ্যোতি এবং জিদানের স্কোর কলির চেয়েও খারাপ ছিল, তার পরও তাদের পাঠানো হয়েছে নতুন শুটার তৈরির লক্ষ্যে। শুধু তাই নয়, উঠতি শুটাররা যেন আরও বড় তারকা হয়ে উঠতে না পারেন, সেজন্য অনুশীলনের সময় দুই সিনিয়র খেলোয়াড়কে লেলিয়ে দিতেন শিপলু। মনোবল ভেঙে দিতে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতেন কোচ শিপলু এবং দুই সিনিয়র শুটার। কোনো কোচিং জ্ঞান না থাকলেও শিপলুই যেন রেঞ্জে শুটিংয়ের সর্বেসর্বা। অথচ তাঁর অজ্ঞতার কারণে গত বছরের জানুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ শুটিংয়ের পদক জেতা হয়নি কামরুন নাহার কলির। শিপলুর দায়িত্বহীনতা এবং অজ্ঞতার কারণে ফাইনালে নির্দিষ্ট সময়ে রেঞ্জে যেতে না পারায় লড়াইয়ের আগেই পুরো ১ পয়েন্ট কেটে নিয়েছিল তাঁর। সহকারী কোচ শিপলুর অত্যাচারে ক্ষুব্ধ শুটাররা। 

ইতোমধ্যে খেলোয়াড়দের দাবির মুখে তাঁকে ফেডারেশন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান এক শুটার। আন্তর্জাতিক শুটাররা সারাদিন ক্যাম্প করেন ডিজিটাল মনিটরে। কিন্তু অ্যানালগ রেঞ্জের প্রায় ২০টি লেইন সারা বছর খালি থাকা সত্ত্বেও যেসব ক্লাব নিজ খরচে প্র্যাকটিস করতে ইচ্ছুক, তাদেরও অনুশীলন করতে দেওয়া হয় না। বারবার ক্লাবগুলো থেকে চিঠি দিলেও মহাসচিব এসবের কোনো তোয়াক্কা করেননি বলে অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ নেভির নিজস্ব রেঞ্জ নেই। তারা শুটিং ফেডারেশনের এই রেঞ্জ ব্যবহার করতে চাইলেও দেননি অপু। এমনও অভিযোগ আছে, শুটারদের ভালো মানের খাবার দিত না ফেডারেশন। যখন কোনো মিডিয়া যেত, সেই সময়ে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করে অপু বোঝাতে চাইতেন তিনি মানসম্মত খাবার দিতেন শুটারদের। 

অপুর আস্থাভাজন শিপলু গুলি নিয়ে করতেন ছয়নয়। শিপলুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর পছন্দের শুটারদের বেশি দামে গুলি দিতেন। অপছন্দের শুটারদের খারাপ গুলিটা ধরিয়ে দিতেন। 

এসব অপকর্ম মহাসচিব অপু, সহকারী কোচ শিপলু এবং ম্যানেজার দেবাশীষ চক্র করত বলে অভিযোগ উঠেছে।  বিদেশ সফর নিয়েও সক্রিয় ছিল অপুর এই চক্রটি। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় কোনো বাহিনীর শুটার বিদেশে খেলতে গেলে পুরো খরচ বহন করে ওই সার্ভিসেস সংস্থাটি। বাহিনীর দেওয়া অর্থ দিয়ে ফেডারেশনের কর্মকর্তাদেরও পাঠাতেন। নির্বাহী কমিটিতে ৭০ থেকে ৮০ বছরের মতো এমন অনেক ব্যক্তিকে ঢুকিয়েছেন অপু, যাদের শুটিংয়ের জ্ঞান নেই বললেই চলে। সম্প্রতি শুটিং ফেডারেশনে অপুর অনিয়ম এবং স্বেচ্চারিতা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বঞ্চিত সাবেক শুটাররা। তারা এই কমিটি ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। তবে বর্তমান খেলা অনেক শুটার এই কমিটির সমালোচনাকারী এসব সাবেক শুটারকেও ফেডারেশনে চাচ্ছেন না। বরং শুটিংয়ের উন্নয়নে নিঃস্বার্থভাবে যারা কাজ করবেন, তাদের চাচ্ছেন তারা। 

এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মহাসচিব অপু, ‘আমার বিরুদ্ধে এগুলো সব ষড়যন্ত্র। যারা এসব বলে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে খুনিও আছেন। ফেডারেশন চলে নিয়মের মধ্যে। যে কোনো কিছু হওয়ার আগে নির্বাহী কমিটিতে ওঠে, সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। আমার একক ক্ষমতায় কোনো কিছু হয় না।’ জানা গেছে, নির্বাহী কমিটিতে যারা আছেন, তারা অপুর বন্ধু এবং স্বজন। তাই অপু যেটা করতে চান, সেটা সহজেই অনুমোদন করে দেন তাঁর আজ্ঞাবহ সদস্যরা।

আরও পড়ুন

×