মেসি যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা
বার্সেলোনা ছাড়তে চাওয়া মেসি। ছবি: ফাইল
জহির উদ্দিন মিশু
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২০ | ০০:৫৮
শহরটার নাম হামেল্কম্ন। সবাই চিনত হ্যামিলন নামে। ছোট্ট, সাজানো, সুন্দর শহর হ্যামিলন। সেই শহরের মানুষের সব থাকলেও ছিল না কোনো সুখ। এক ইঁদুরের উৎপাত তাদের রাতের ঘুম হারাম। ১২৮৪ সালের সেই হ্যামিলন শহরের গল্পটা এখনও অনেকের মনে রহস্যের আঁধার হয়ে আছে। একবিংশ শতকে এসে তেমন কোনো বাঁশিওলার দেখা না মিললেও লিওনেল মেসি যেন পুরোনো গল্পটাই আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন সবাইকে। হয়তো ভিন্নভাবে, রূপক কোনো চরিত্রে এই মেসির মাঝে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তেমনি একজন বাঁশিওলাকে, হোক না সেটা ক্লাব ফুটবলে!
হ্যামিলনের মেয়র যেমন বাঁশিওলাকে কথা দিয়েও রাখেননি কথা। যার ফলও হয়েছিল ভয়াবহ। ঠিক তেমনি বার্সা মেসির সঙ্গে করেছে বৈরিতা, তাকে নানাভাবে করেছে হেয়, কেড়ে নিয়েছে স্বাধীনতা, হরণ করেছে 'পাওয়ার অব লিডারশিপ'। শেষ পর্যন্ত মেসি যদি নতুন ঠিকানায় নাম উঠিয়েও ফেলেন, তাহলে বার্সার পরিণতি কেমন হবে সেটা বলা মুশকিল।
'আমি আর বার্সায় থাকতে চাই না' এই বাক্যটা বাতাসের মতো ছড়িয়ে যায় ফুটবল দুনিয়ায়। তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে একের পর এক নামিদামি ক্লাব। সবাই এখন মেসিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। কী জায়ান্ট ক্লাব, কী তলানির দল। ছোট-বড় সব ক্লাবের বোধহয় একজন মেসি চাই।
ডাকছে ওল্ড বয়েজ
প্রাণের শহর রোজারিও। সেই শৈশবের স্মৃতিমাখা দিনগুলো মেসিকে আরেকবার জানাচ্ছে আমন্ত্রণ। যেই খবর বেরোল মেসি আর বার্সায় থাকবেন না, তারাও নামলো রাস্তায়। যেখানে বিশ্বের তাবড় দল তার জন্য পথ চেয়ে, সেখানে নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজও চাচ্ছে তাকে নিতে। মেসি কী চিন্তা করেছেন বার্সা ছেড়ে এখনই সেখানে যাবেন। কে জানে? তবে মেসি চিন্তা করুক আর নাই করুক, ওল্ড বয়েজের ভক্তকুল খুব করে ভেবেছেন মেসি আসবে, তার ছোট্টবেলার ক্লাব ওল্ড বয়েজেই আসবে। তাই তো বৃহস্পতিবার দিনভর রাস্তায় মেসির জন্য অপেক্ষা তাদের। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত পুরো রোজারিও শহর। আতশবাজি, প্ল্যাকার্ড, রংবেরঙের ফেস্টুন আর জার্সি গায়ে বেরিয়েছে তারা। ডাকছে মেসিকে, প্রিয় ফুটবলারের জন্য তারাও ভাসিয়েছে আশার ভেলা।
মেসির বাবা বলেছেন, ছেলে সিটিতেই যাবে
একের পর এক টুইটে নানা ইঙ্গিত। নতুন নতুন গুঞ্জন আর আশা-নিরাশার গল্প সাজানো। এই ম্যানচেস্টার সিটি তো বহু আগে থেকেই মেসির জন্য পথ চেয়ে। বার্সায় যখনই তার মন খারাপ হতো, যখন ক্লাব ছাড়ার গুঞ্জন বাতাসে ঘুরত, তখনই সিটিজেনরা তাকে পাঠাত প্রস্তাব। কিন্তু মেসি থাকতেন অনড়, কয়েক দিন অভিমান করে পরে আবার ঠিকই বার্সাকে আগলে নিতেন। এবার বুঝি আর সেসব হচ্ছে না। শেষবারের মতো বেজেছে বাঁশি। যাওয়ার ক্ষণ গোনাও শুরু। এদিকে ম্যানসিটি চাচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব তাকে ইতিহাদে উড়িয়ে আনতে। এই অপেক্ষার প্রতিটা মুহূর্ত মনে হয় সিটির কাছে ঘণ্টার চেয়েও বেশি। সর্বশেষ খবর, মেসি সিটিকেই বেছে নিয়েছেন। গতকাল ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম এল ইকুইপে বলছে, মেসির বাবা পিএসজির স্পোর্টিং ডিরেক্টর লিওনার্দোকে বলে দিয়েছেন মেসি পিএসজি নয়, সিটিতেই যাবেন।
তবে বার্সা বেঁকে বসায় মেসির সিটি যাত্রা হতে পারে কঠিন থেকে কঠিনতর। চুক্তির এক মারপ্যাঁচে মেসিকে আটকে দিতে চাচ্ছে কাতালানরা। আর এই প্যাঁচ থেকে ছুটতে মেসিও বসে নেই। ফিফার কাছে নালিশ জানিয়েছেন। যাতে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই তাকে ছাড়া হয়, তাও আবার ফ্রিতে। ২০১৭ সালে একবার কোমর বেঁধেই নেমেছিল ম্যানসিটি। সেবার মেসিকে দ্বিগুণ বেতনে আনার কথাও বলে দলটি। কিন্তু মেসি তাদের সেই ডাকে সাড়া দেননি। ২০১৮ সালের দিকে নিজ মুখেই তিনি বিষয়টি স্বীকার করেন। টিওয়াইসি স্পোর্টসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মেসি বলেন, 'তারা আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিল। আসলে আমি বার্সাতেই ভালো আছি। আমি এখানটাই ক্যারিয়ারের ইতি টানতে চাই।' আজ কী এমন হয়ে গেল সেই মেসিই মুখ ফিরিয়ে নিলেন বার্সা থেকে।
পথে আছে ইন্টার
গত বিশ্বকাপের পর হুট করেই স্পেন ছেড়ে ইতালিতে চলে যান ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তার যাওয়ার পেছনে কারণ ছিল একাধিক। রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন, স্পেনের ট্যাক্স বিড়ম্বনাসহ আরও কয়েকটি কারণে রিয়ালকে রেখে জুভেন্তাসে নাম লেখান সিআর সেভেন। রোনালদো যাওয়ার পর তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মেসিকেও তিনি আমন্ত্রণ জানান। যদিও মেসি তখন হ্যাঁ, না কিছু বলেননি। তাছাড়া ইতালিয়ান ক্লাবগুলো তাকে পাওয়া যে দিবাস্বপ্ন সেটা এক প্রকার ধরেই নেয়। এখন যখন মেসি বার্সা ছাড়ার কথা বলল, তখন ঠিকই বসে নেই। বাকিরা খোঁজখবর রাখলেও ইন্টার চেষ্টা করে যাচ্ছে মেসিকে টানতে।
দৌড়াচ্ছে পিএসজি
ম্যানসিটি শুরু থেকে ছিল মেসিকে কেনার দৌড়ে। এখন পর্যন্ত তারাই এই লড়াইয়ে এগিয়ে। তবে দেরিতে হলেও পিএসজি নেমেছে মাঠে। লক্ষ্য মেসিকে প্যারিসে আনা। বলাটা সহজ হলেও কাজটা যে বহু কঠিন, সেটাও ভালো করে জানে দলটি। অতীত অভিজ্ঞতাও তাদের বাড়তি ধারণা দেবে। কেননা, এর আগে নেইমারকে আনতে বহু ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তবু আশা ছাড়া যায় না। নেইমারের সঙ্গে দারুণ একটা সম্পর্ক মেসির। এমনকি বার্সা ছাড়ার পরও ব্রাজিলিয়ান তারকার সঙ্গে কথা হতো। পিএসজি চাচ্ছে এই দু'জনকে আবার এক ছাতার নিচে করতে। যেটা পিএসজির জন্য হতে পারে আরও দারুণ কিছু।
বসে নেই ম্যানইউ
গত কয়েকটা মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পারেনি তাদের আশানুরূপ ফল ঘরে তুলতে। একের পর এক ভুল দল বদলে হতাশ খোদ ম্যানইউ মালিকও। তাই তো এবার মেসিকে বাগে আনতে মরিয়া তারাও। শুরু থেকে ম্যানসিটির সঙ্গে সমানভাবে লড়ছে দলটি। ইংলিশ গণমাধ্যমের খবর, মেসির বাবার দুয়ারেও গেছে ম্যানইউর প্রতিনিধি দল। উদ্দেশ্য তাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে মেসিকে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে আনা। এ জন্য যত অর্থ ঢালা লাগে ঢালতে রাজি দলটি। ম্যানইউর সাবেক তারকারাও মেসিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। সাবেক ফুটবলার রুনি তো বলেই দিলেন, হয় ম্যানইউ না হয় ম্যানসিটি- এ দুই ক্লাবের হয়ে মেসি তার সপ্তম ব্যালন ডি'অর জিততে পারে।
স্বপ্ন ছিল তাদেরও
সময়টা একদমই ভালো যাচ্ছে না আর্সেনালের। প্রিমিয়ার লিগে গেল কয়েকটা মৌসুম খুব সংগ্রাম করছে দলটি। দল বদলেও নেই কোনো চমক। তাই তারাও এবার মেসির বার্সা ছাড়ার খবর শুনে স্বপ্ন দেখেছিল। বসেছিল নড়েচড়ে। যদিও মোটা অঙ্কের বেতন দিয়ে বিশ্বসেরা ফুটবলারকে নিজেদের ডেরায় রাখা সহজ না, বিষয়টি দেরিতে হলেও বুঝেছে তারা। এ ছাড়া বায়ার্ন মিউনিখও একটা দৌড় দিতে চেয়েছে। শেষমেশ তারা সরে আসে সেই সিদ্ধান্ত থেকে। করোনার এই ক্রান্তিকালে মেসির মতো তারকাকে আনতে যে কোষাগার খালি করতে হবে বাভারিয়ানদের সেটা ভেবেই বোধহয় পিছ পা হলো দলটি।