ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

স্ট্রেইট ড্রাইভ

জাতীয় দলে 'পাণ্ডব' আর 'কৌরব' কেন?

জাতীয় দলে 'পাণ্ডব' আর 'কৌরব' কেন?

সঞ্জয় সাহা পিয়াল

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২১ | ২২:৪৭

'পঞ্চপাণ্ডব'; পৌরাণিক মহাভারতের পাঁচ ভাইয়ের এই চরিত্রগুলোকে বাংলাদেশ ক্রিকেটে কে বা কারা নিয়ে এসেছিল- তা জানতে পাঠকের কৌতূহল প্রচুর। অতীতে অনেককে জিজ্ঞাসাও করলেও উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে স্মৃতিতে যেটুকু মনে পড়ে, তা হলো, ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় কলকাতার একটি জনপ্রিয় দৈনিকে মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবালকে নিয়ে একটি শিরোনাম হয়েছিল 'বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডব'। সে থেকেই শব্দটি এখানেও প্রতিষ্ঠিত এবং গত পাঁচ বছরে একটা মিথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা সেই পঞ্চপাণ্ডবের একজন মাশরাফি বিন মুর্তজার অঘোষিত অবসর হয়ে গেছে। তামিম ইকবালও সম্প্রতি কিছু মিডিয়ায় যে কোনো একটি ফরম্যাট থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। হঠাৎই পঞ্চপাণ্ডবের এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন মিডিয়ায় একের পর এক সাক্ষাৎকারে সবার সুরেই আগামীর ভাবনা এবং 'আমরা তো অনেক করেছি, বাকিদের এখন করার সময়' জাতীয় সুর। যা দেখে ফেসবুকে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের একটি স্ট্যাটাস- 'দলের ভেতরে দল। পাঁচ পাণ্ডব বনাম বাকি খেলোয়াড়। সবার কথাবার্তায় দলের বাকি খেলোয়াড়দের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে হয়। দল ছেড়ে এখন ব্যক্তি ক্রিকেটারদের পেছনে সবাই। বাংলাদেশ দলটাকে খুঁজে পাই না...।'

মারাত্মক অভিযোগ। মিডিয়ার দিকেও অনুযোগের আঙুল তুলেছেন তিনি। একটু গভীরে গিয়ে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের স্ট্যাটাস বিশ্নেষণ করলে ধরা পড়ে সত্যিটাও। তথাকথিত এই পঞ্চপাণ্ডবদের আগমনের পর থেকে (ধরা যাক ২০০৬ থেকে) এ পর্যন্ত ২৫৩টি ওয়ানডে খেলেছে বাংলাদেশ দল। যার মধ্যে জয় ১১৫টিতে। এখন এই জয়ের মধ্যে ওই 'পঞ্চপাণ্ডব' ম্যাচসেরা হয়েছেন মোট ৫৭টিতে। তাহলে বাকি ৫৮ ম্যাচে বাংলাদেশকে জিতেয়েছিলেন কারা? তারা যদি পাণ্ডব না হন তাহলে কি তারা মহাভারতের 'কৌরব'? যারা কিনা পরের ম্যাচে কিংবা পরের সিরিজে জায়গা পাবেন কিনা, তা মাথায় নিয়েই খেলতে নামেন। তাদের গিনিপিগ বানিয়েই টিম ম্যানেজমেন্টের যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। কারও খেলার নিজস্ব স্টাইলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয় অন্যদের। দল হেরে গেলে পাঁচজন বাদে সমালোচনা শুনতে হয় কেবল বাকি ওই ছয়জনকেই। এভাবে নিজের ওপর মানসিক চাপ নিতে নিতেই অনেক ম্যাচ জেতানো ক্রিকেটারকে নীরবে হারিয়ে যেতে দেখেছে বাংলাদেশ দল।

মনে আছে উইন্ডিজকে একার হাতে হারানো সোহাগ গাজীর কথা, এশিয়া কাপে নাসির হোসেনের কথা, ফিনিশার সাব্বির রুম্মন, ওপেনার ইমরুলের কথা। মিডিয়ার প্রতিনিয়ত সমালোচনার চাপ তাদেরই সহ্য করতে হয়েছে। পঞ্চপাণ্ডবকে রেখে কৌরবদের নিয়েই সমালোচনা করে ফেসবুকে লাইক পাওয়ার লোভ অনেকেই সামলাতে পারেনি। গত দেড় যুগে তথাকথিত পঞ্চপাণ্ডবকে কি কখনও পারফরম্যান্সের কারণে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে (শুধু গতবছর রিয়াদকে টেস্ট থেকে বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে)? হয় ইনজুরি, না হয় ব্যক্তিগত কারণে তাদের বাইরে রাখা হয়েছে নিরুপায় হয়ে। অথচ বাকিদের বেলায় সিরিজ জেতানো না পর্যন্ত বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তিতেও নিয়মিত রাখা হয়নি। বাংলাদেশ দলের এই কৌরবদের কথাই নিজের স্ট্যাটাসে লিখেছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তার মনে হয়েছে এখন আর কেউ 'বাংলাদেশ দল' নিয়ে ভাবে না, সবার আবেগ তাদের নিজস্ব পছন্দের ক্রিকেটারদের নিয়ে। তাকে ভুল বলা যায় না এই কারণে যে, নিউজিল্যান্ডে টি২০ সিরিজে একটি নতুন দলকে স্ট্রাগল করা দেখে অনেককেই হাসতে দেখা যায়। পাণ্ডব এবং কৌরব বর্জিত ফের একটি 'বাংলাদেশ দল' গড়তে একটু সময় দিতেই হবে।

এখন যারা 'পাণ্ডব' তারা কি শুরুতে স্ট্রাগল করেননি। গত ছয় বছরে বাংলাদেশ দল যে ৪৬টি ম্যাচ জিতেছে তার মধ্যে সিনিয়র পাঁচজন ম্যাচসেরা (যদি ম্যাচসেরার পুরস্কারকে ম্যাচ জেতানোর স্বীকৃতি ধরা হয়) হয়েছেন মোট ২৭টি। তাহলে বাকি ১৯টি ম্যাচ নিশ্চয়ই ওই তথাকথিত 'কৌরব'রা জিতিয়েছেন এবং অবশ্যই মাঝে প্রচণ্ড সমালোচনা শুনেই হয়েছেন। পঞ্চপাণ্ডবের পর দলকে এগিয়ে নিতে হলে একটি প্রজন্ম তৈরি করতেই হবে। কিন্তু সেটা গত পাঁচ বছরে হয়েছে কি? নতুন কাউকে দলে নিতে হয়েছে অটোচয়েজ ওই 'পাঁচ'-এর জায়গা আগে ঠিক রেখে। উদাহরণ দিতে গিয়ে অনেকেই ভারতের নতুন প্রজন্মের কথা বলে। অথচ তারাই ভুলে যায়, গত এক দশকে বিরাট কোহলি বা রোহিত শর্মারা কোথায় নিয়ে গেছেন তাদের দলটিকে। রিয়াদ তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে মাত্র পাঁচবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন, দুইশর ওপর ম্যাচ খেলে মুশফিক হয়েছেন আটবার। ২১৩ ম্যাচ খেলে তামিম ১৫ বার। সবচেয়ে বেশি সাকিব হয়েছেন ২২ বার। মাশরাফি হয়েছেন ১২ বার। ২০০৭ সালের পর তিনি ম্যাচসেরা হয়েছেন সাতবার। এসব পরিসংখ্যান বলে দেয়, সময় তাদেরও লেগেছিল। সময় নতুনদেরও দিতে হবে এবং প্রয়োজনে নিজের জায়গাটি ছেড়ে (সেটি না ছেড়ে উপদেশ দিলে সেটা স্বার্থপরতা মনে হতে পারে)।

'দলের মধ্যে দল' আমিনুল ইসলাম বুলবুলের এই উপদল সত্যিই কারও কাম্য নয়। কুরুক্ষেত্রের মতো 'পাণ্ডব' আর 'কৌরব'ও কেউ দেখতে চায় না। সবাই চায় সেই টিম বাংলাদেশ দেখতে, যাদের বিশ্ব চেনে 'টাইগার্স' নামে।

আরও পড়ুন

×