ব্যাপক দরপতন শুরু হয়েছে শেয়ারবাজারে। দরপতনের ব্যাপকতা আরও বাড়বে– এমন আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা লাভ বা লোকসানের দিকে না তাকিয়ে শেয়ার বিক্রি করছেন। গত সোমবারের পর বুধবারও একই চিত্র দেখা গেছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে।

বুধবার প্রকাশিত এইচএসবিসি গ্লোবালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত ও ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশের শেয়ারবাজারেও বড় ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে। ওই দেশ দুটির মধ্যে বাংলাদেশেও দীর্ঘ মেয়াদে কোম্পানিগুলোর আয় বাড়তে পারে। ফলে শেয়ারবাজার থেকেও বিনিয়োগকারীদের মুনাফা করার সুযোগ আছে।

এইচএসবিসি গ্লোবাল এমনটি মনে করলেও বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা এ মুহূর্তে নানা শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। গত দুই দিনের পতনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৬২২০ পয়েন্টে এবং লেনদেন সাড়ে ৩০০ কোটি টাকায় নেমেছে। বুধবার দিন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক গত ১৭ এপ্রিল এবং লেনদেন ২৮ মার্চের পর সর্বনিম্নে নেমেছে। এদিন ১৫টিসহ ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসা শেয়ার সংখ্যা ২৪০টিতে উন্নীত হয়েছে, যা তালিকাভুক্ত মোট শেয়ারের ৬১ শতাংশের বেশি।

পরিস্থিতি সামাল দিতে করণীয় নির্ধারণে আবারও অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক ডেকেছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনাকারী সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি এবং বেলা ১১টায় নির্দিষ্ট শীর্ষ ব্যাংক, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। বৈঠকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে উপস্থিত থাকবেন কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ এবং মিজানুর রহমান।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা জানান, দরপতন রুখতে গত বছরের জুলাইয়ের শেষে নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দিয়েছিল, কৃত্রিম এ দরের তুলনায় আর দরপতনের সুযোগ নেই। তারপরও ক্রেতা নেই সিংহভাগ শেয়ারের। এ অবস্থাও দরপতনের কারণ– অল্প কিছু যে শেয়ারের দর ফ্লোর প্রাইসের ওপরে আছে, সেগুলো ক্রমাগত দর হারাচ্ছে।

বুধবার প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৩৯২ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে কেনাবেচা হয়েছে ৩০১টির। এর মধ্যে মাত্র ১৬টির দর বেড়েছে। বিপরীতে দর হারিয়েছে ১৪৬টির এবং বাকি ২২৩ শেয়ারের দর অপরিবর্তিত ছিল, ফ্লোর প্রাইসের কারণে এসব শেয়ারের দরপতন হতে পারেনি।

দেশের দ্বিতীয় শেয়ারবাজার সিএসইতেও ছিল একই অবস্থা। এ বাজারে তালিকাভুক্ত ৩৭০ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে মাত্র ১৫৯টির কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১১টির, কমেছে ৭৫টির এবং ৭৩ শেয়ারের দর অপরিবর্তিত বা ফ্লোর প্রাইসে আটকে ছিল। এর বাইরে ক্রেতার অভাবে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৯১ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের কোনো কেনাবেচাই হয়নি। অন্যদিকে সিএসইতে ২১১ কোম্পানির একটি শেয়ারও কেনাবেচা হয়নি। কারণ একটাই– এসব শেয়ারের দর বিদ্যমান বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

বুধবারই ১৪ শেয়ার ও একটি মিউচুয়াল ফান্ড নতুন করে ফ্লোর প্রাইসে নেমেছে। এগুলো হলো– শাহ্জালাল ব্যাংক, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, তাকাফুল ইন্স্যুরেন্স, ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, মীর আকতার লিমিটেড, ন্যাশনাল টিউবস, স্কয়ার ফার্মা, রহিমা ফুড, জিল বাংলা সুগার মিলস, আরামিট সিমেন্ট, মুন্নু সিরামিক, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক এবং এপেক্স ট্যানারি। এ ছাড়া সোমবার ফ্লোর প্রাইস ছাড়ার পর বুধবারই রিলায়েন্স প্রথম মিউচুয়াল ফান্ডটি ফের ফ্লোর প্রাইসে নেমেছে।

এমন দরপতনের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ কেউ ব্যাখ্যা করতে পারছে না। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে নানাজন নানা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছরের মধ্যে বিদেশি ঋণ ও পণ্য ক্রয় বাবদ বাংলাদেশকে ১২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে– এমন একটি কথা বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। আর বিনিয়োগকারীদের শঙ্কা, যদি এমনটি হয় তাহলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ব্যাপক পতন হবে, অর্থনীতি কঠিন চাপে পড়বে।

শীর্ষ এক ব্রোকারেজ হাউসের এমডি বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক অস্থিরতা বিরাজ করছে। এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো চললেও আগামীতে সহিংস পরিস্থিতির শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না– এমন ধারণা অনেক বিনিয়োগকারীর। ফলে আরও দরপতনে পুঁজি কমার আগে কিছু বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ক্রমাগত ক্রেতা কমছে।

যেমন, বুধবার লেনদেনের প্রথম ঘণ্টার বিক্রির চাপে ডিএসইতে ১০৯ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঘণ্টায় তা নেমে যায় ৭২ কোটি টাকায়, তৃতীয় ঘণ্টায় আরও কমে মাত্র ৪৩ কোটি টাকায় নামে। শেষ পর্যন্ত সাড়ে চার ঘণ্টায় কেনাবেচা হয় ৩৫১ কোটি টাকার শেয়ার।

এ ছাড়া বৃহৎ মূলধনি প্রায় সব শেয়ারসহ সিংহভাগ শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে টাকায় বাজার মূল্য সূচকের পতনের সুযোগ খুবই কম। এর মধ্যেও ডিএসইএক্স ৩৬ পয়েন্ট হারিয়ে ৬২২০ পয়েন্টে নেমেছে। সূচকের এ অবস্থান চার মাসের সর্বনিম্ন।

এ অবস্থার কারণ কী– জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, ‘নানা গুজবে দরপতন হচ্ছে। কারা গুজব ছড়াচ্ছে, তা চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।’ কী গুজব ছড়াচ্ছে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয় পদত্যাগ করছেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হচ্ছে– এ ধরনের গুজবই বেশি।’ শিগগির বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।