- শেয়ারবাজার
- নিজের আইন নিজেই লঙ্ঘন ডিএসইর
নিজের আইন নিজেই লঙ্ঘন ডিএসইর

শেয়ার কেনাবেচার বিকল্প প্ল্যাটফর্ম অলটারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড বা এটিবি ‘ডে-ট্রেডিং’-এর জন্য নয়। চালুর আট মাস না যেতেই এ বাজারের আইন বদলে দিয়ে এ রকম বাজারই করতে চাচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। শুধু চাচ্ছে না, এরই মধ্যে নিজের আইনই লঙ্ঘন করে ফেলেছে ডিএসই। এখন চাচ্ছে আইন বদলে তা জায়েজ করতে।
আইন লঙ্ঘন করে এমন মুনাফা করার সুযোগ করে দিয়েছে খোদ ডিএসই। নিজেদের দোষ ধামাচাপা দিতে সংস্থাটি এটিবি আইনের বিধান ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলেছে। শেয়ারদর কেনাবেচায় দর নির্ধারণ বিষয়ে মূল আইনের ধারা বিকৃত করে আইনের খণ্ডিত অংশ প্রকাশ করেছে।
এটিবি পরিচালনা-সংক্রান্ত আইনের নাম ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (অলটারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড) রেগুলেশনস, ২০২২। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন এবং বিএসইসির সম্মতিতে এর সরকারি গেজেট গত বছর প্রকাশ হয়। এটিবি চালু হয় গত ৪ জানুয়ারি। এটিবি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শুধু মূল শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় বা তালিকাভুক্তির যোগ্যতা নেই এমন কোম্পানির শেয়ারের মালিকানা বদলের সুযোগ দিতে।
আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, এটিবির শেয়ার লেনদেন ব্যবস্থা কোনোভাবেই ‘ডে-ট্রেডিং’ ব্যবস্থা হবে না। শুধু কোনো কোম্পানির শেয়ার বা ফান্ড ইউনিটের মালিকানা বদলের মাধ্যমে কারও বিনিয়োগ করা এবং অন্যের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ব্যবস্থা হবে। ‘ডে-ট্রেডিং’ শব্দের ব্যাখ্যায় এ আইনেই বলা হয়েছে, ডে-ট্রেডিং অর্থ, দিনে দিনে শেয়ার কেনাবেচা করে মুনাফা করার মানসিকতা, যা বিনিয়োগ বা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ছাড়া আইনের ৯(৫)(জি) ধারায় বলা হয়েছে, এ বাজারে কোনো বিনিয়োগকারী শেয়ার কেনার পর ৯০ দিনের আগে বিক্রি করে মুনাফা করলে ওই মুনাফা নিতে পারবেন না। মুনাফার টাকা ডিএসইর বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলে দিয়ে শুধু মূল টাকা নিতে পারবেন। ডে-ট্রেডিং মানসিকতায় শেয়ার কেনাবেচা রুখতেই এমন নিয়ম করা হয়।
মূল শেয়ারবাজারের মতো এ বাজারে যে কোনো দামে যাতে শেয়ার কেনাবেচা না হয়, তা নিশ্চিতে আইনের ৯(৫)(এফ) ধারায় বলা হয়েছে, তালিকাভুক্তির প্রথম দুই দিন সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার তার ফেয়ার। ভ্যালু বা যৌক্তিক মূল্যের ওপর সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ এবং পরবর্তী কর্মদিবস থেকে ওপরে বা নিচে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ দর সীমার মধ্যে কেনাবেচা করা যাবে। এ ধারায় শেয়ারের যৌক্তিক দরের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এ বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির যৌক্তিক শেয়ারদর হবে কোনো নির্দিষ্ট বছরে ওই কোম্পানির এনএভি এবং ‘ডিভিডেন্ড ইয়েল্ডভিত্তিক’ শেয়ারদরের গড়। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর পরবর্তী নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত একই দরের ওপর শেয়ার কেনাবেচার দরসীমা বহাল থাকবে। গত ৪ জানুয়ারি লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ এটিবিতে তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানিটির যৌক্তিক শেয়ারদর ছিল ১৪ টাকা ৯০ পয়সা। ফলে শেয়ারটি সর্বনিম্ন ১৪ টাকা ১০ পয়সার নিচে এবং ১৫ টাকা ৬০ পয়সার বেশি দরে কেনাবেচার সুযোগই নেই। তবু তালিকাভুক্তির ১৭তম কার্যদিবসেই শেয়ারটি ৩০ টাকা দরে কেনাবেচা হয়। ডিএসই সার্কিট ব্রেকারের নিয়ম বদলে যৌক্তিক মূল্যের পরিবর্তে আগের দিনের সমাপনী মূল্যের ওপর প্রতিদিনই সার্কিট ব্রেকার নির্ধারণ করে এ দর বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়।
আইন সরিয়ে এখন এই আইনি বিধানের ৯(৫)(জি) ধারা স্থগিত এবং ৯(৫)(জি) ধারা সংশোধন করে ফেয়ার ভ্যালুর স্থলে ‘গতকালের ক্লোজিং প্রাইস’ প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব করেছে ডিএসই। গত ১৬ জুলাই এ বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে পাঠিয়েছে।
কী করে লংকাবাংলার শেয়ার ১৫ টাকা ৬০ পয়সার বেশি দরে কেনাবেচা হলো– এমন প্রশ্নে ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত এমডি সাইফুর রহমান মজুমদার সমকালকে বলেন, আগের দিনের ক্লোজিং প্রাইসের ভিত্তিতে প্রতিদিন ৫ শতাংশ বৃদ্ধির সুযোগ আছে। সেভাবেই বেড়েছে। কিন্তু আইনের সুনির্দিষ্ট বিধানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভুল করে আইনের সার্কিট ব্রেকার আগের দিনের ক্লোজিং প্রাইসের বদলে ফেয়ার ভ্যালু উল্লেখ করা হয়েছে। এখন এটাই সংশোধন চাচ্ছি।’
‘এখন এ বিধানটি সংশোধনের জন্য কমিশনে আবেদন করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘৯০ দিনের মধ্যে শেয়ার কেনাবেচায় মুনাফা হলে তা নেওয়া যেত না। এ-সংক্রান্ত বিধান প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছে ডিএসই। এসব ধারা থাকলে কোনো কোম্পানি এটিবিতে তালিকাভুক্ত হতে আসবে না, বিনিয়োগকারীও আসবেন না। ডিএসইর অপর এক কর্মকর্তা জানান, নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন পরিবর্তনের পক্ষে সম্মতি আছে। তবে তারা পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে বিদ্যমান বিধান সংশোধনের প্রস্তাব পাঠাতে বলেছে।
জানতে চাইলে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ সমকালকে বলেন, যারা বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করতে চান এবং যেসব বিনিয়োগকারী ঘন ঘন শেয়ার কেনাবেচায় মুনাফা করতে চান, তাদের জন্য মূল মার্কেট ও এসএমই মার্কেট আছে। এ বাজারটি যেহেতু বিকল্প বাজার, এর চরিত্র নষ্ট করার অর্থ হলো তারা অন্য কিছু চায়; যেমনটি এসএমই বোর্ডে হচ্ছে। এসএমই মার্কেটে প্রতিদিন একটি দুটি করে কেনাবেচা করে ৩৫ টাকা দামের শেয়ার সাড়ে তিন মাসে ১ হাজার ৪৩২ টাকায় তুলেছে। এটা করতে ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারীকে এ বাজারে ডেকে আনা হয়েছে।
মন্তব্য করুন