- সিলেট
- সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামানোর প্রতিশ্রুতি শূন্যেই ঝুলছে
সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামানোর প্রতিশ্রুতি শূন্যেই ঝুলছে

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোলাপাড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত পরিবারে মাতম সমকাল
সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বারবার প্রতিশ্রুতি মিলেছে, ঐকমত্যে পৌঁছেছে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি পাল্টায়নি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে অন্তত ১২ জন গুলিতে নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১৩ জন। এ ছাড়া আটজনকে অপহরণের অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ বুধবার রাতে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোলাপাড়া সীমান্তে আবারও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত হন দুই বাংলাদেশি। তাঁরা হলেন- মংলু (৩৬) ও সাদিক হোসেন (২২)। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও দু'জন। এর আগে চলতি মাসেই লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এক যুবক নিহত হন। সব মিলিয়ে এ বছর সীমান্তে অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন।
চলতি মাসেই ভারতের আগরতলায় অনুষ্ঠিত বিজিবির রিজিয়ন কমান্ডার ও বিএসএফের ফ্রন্টিয়ার আইজি পর্যায়ের তিন দিনব্যাপী সীমান্ত সম্মেলন শেষে বলা হয়, সীমান্তে গুলি করে হত্যা বন্ধে একমত হয়েছে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত সপ্তাহে রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারাও এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না। এর আগে ১৭ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম লালমনিরহাটে এক অনুষ্ঠানে বলেন, সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে কাজ করছে দুই দেশ। এ নিয়ে সম্প্র্রতি এক বৈঠকে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একমত হয়েছেন।
সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়ে এ জাতীয় বক্তব্য, আলোচনা বা ঐকমত্য নতুন কিছু নয়। এমনকি চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতিতে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই দিনাজপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশি কিশোর নিহত হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতেই অবস্থান করছিলেন।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় ও নীতিনির্ধারকদের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার বৈঠক করে প্রতিশ্রুতি দিলেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। পাকিস্তান সীমান্তে কিন্তু এমনটা ঘটছে না। এখানে দেখার বিষয় হলো, দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্কটা কেমন? নতজানু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নাকি মর্যাদাপূর্ণ বন্ধুত্ব? আমার মনে হয়, এটির সুরাহা এখন আর দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দ্বিপক্ষীয় চেষ্টা তো অনেক হলো। এখন জাতিসংঘের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
আরও দু'জন নিহত :বুধবার রাত ১টার দিকে হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা ইউনিয়নের দোলাপাড়া সীমান্তের মেইন পিলার ৮৮৭-এর সাব-পিলার এস ৮ এলাকায় বিএসএফের গুলিতে দু'জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে মংলু উপজেলার ফকিরপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব ফকিরপাড়া গ্রামের আব্দুস সামাদের ছেলে। আর পার্শ্ববর্তী বড়খাতা ইউনিয়নের দোলাপাড়া গ্রামের হাফিজার রহমানের ছেলে সাদিক। এ ঘটনায় আহত আব্দুল গণি (৩৭) ও সাজু (২৮) রংপুরের একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
নিহতের পরিবার ও স্থানীয়রা জানান, বুধবার রাতে বাংলাদেশি গরু পারাপারকারীদের একটি দল সীমান্ত এলাকায় গেলে ভারতের ১৫৭ ব্যাটালিয়নের বড় মধুসূদন বিএসএফ ক্যাম্পের টহল দল তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এতে কাঁটাতার সংলগ্ন শূন্যরেখা বরাবর গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান দু'জন। তাঁদের সঙ্গীরা লাশ উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে সাদিক তলপেটে ও মংলু বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আহত দু'জনের হাত ও পায়ে গুলি লেগেছে।
নিহত সাদিকের মা মোছা. সামিউন জানান, রাতের খাবার খেয়ে বাসা থেকে বের হয় তাঁর ছেলে। এর পর কী হয়েছে জানেন না। পরে তাঁর লাশ বাড়িতে নিয়ে আসে লোকজন।
নিহতের চাচা হুমায়ুন কবির জানান, সাদিকের মৃত্যুতে পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
মংলুর বাবা আব্দুস সামাদ দাবি করেন, তাঁর ছেলে গরু আনতে সীমান্তে যায়নি। বাড়ির পাশে সীমান্ত হওয়ায় এমনিতেই সেখানে গিয়েছিল।
বড়খাতা ইউনিয়নের দোলাপাড়া ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলাম জানান, রাতে সীমান্তে গুলির শব্দে তাঁদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। পরে জানতে পারেন, সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দু'জন মারা গেছেন।
দোলাপাড়া বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার সুবেদার আব্দুল জলিল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে ৬১ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর হাসান শাহরিয়ার মাহমুদ জানান, খবর পেয়ে তাঁরা নিহতদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে বিজিবি। খোঁজখবর নিয়ে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হবে।
এর আগে গত ১৫ ডিসেম্বর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে শাহাদত হোসেন (২৭) নামে এক যুবক নিহত হন। গত ২৬ নভেম্বর হাতীবান্ধা উপজেলার দইখাওয়া সীমান্তে সাদ্দাম হোসেন (৩২) নামে আরেক যুবককে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ ওঠে বিএসএফের বিরুদ্ধে। ১৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তের জোহরপুর ও ওয়াহেদপুরের মধ্যবর্তী এলাকায় গুলিতে মোহাম্মদ শামীম নামে এক যুবক নিহত হন। স্বজনের দাবি, বিএসএফের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে বিজিবি বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
এদিকে লালমনিরহাট সীমান্তে বিভিন্ন সময়ে বিএসএফের গুলিতে নিহত ছয় বাংলাদেশির লাশ ভারতের হিমঘরে পড়ে আছে। তাঁদের মধ্যে পাটগ্রাম সীমান্তে তিনজন, কালীগঞ্জ সীমান্তে দু'জন ও আদিতমারী সীমান্তে একজন মারা যান।
২১ জুলাই রাজধানীর পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরে পাঁচ দিনব্যাপী সীমান্ত সম্মেলন শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিং দাবি করেন, সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত সবাই মাদক কারবারসহ নানা অপরাধে জড়িত।
মন্তব্য করুন