প্রচণ্ড আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক, কখনও কখনও নিষ্ঠুরও বটে- নব্বইয়ের দশকের এমন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেই তো চেনাজানা ক্রিকেট পৃথিবীর। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল অসিদের সেই মেজাজ। বয়স হয়েছে ওয়ার্নার-স্মিথদের, লোকে বলাবলি করেছিল বটে। শেন ওয়ার্নের মতো সাবেকরাও এই 'বুড়ো' অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে খুব বেশি আশার কথা শোনাননি বিশ্বকাপের আগে। বরং নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ডকে নিয়েই টক শোগুলোতে বেশি বাক্য খরচ করেছেন সাবেক অসি তারকারা। 

কিন্তু সেমিফাইনালে ওঠার পর থেকেই একটু 'দাম' পাচ্ছেন অ্যারোন ফিঞ্চরা। তাই তো অনেকটা অভিমানের সুরেই পাকিস্তান ম্যাচের আগে ফিঞ্চ বলেছিলেন- দশ দিন আগেও তো আমরা 'বুড়ো' দল ছিলাম, এখন আমাদেরই 'অভিজ্ঞ' বলা হচ্ছে। সত্যিই তো তাই, বিশ্বকাপের আগে যে দল চার-চারটি সিরিজ হেরেছে, তাদের নিয়ে আর কতই বা স্বপ্নের ফানুস ওড়ানো যায়। কিন্তু ওই যে 'অস্ট্রেলিয়া' নামের মধ্যেই তো ক্রিকেটের ক্ল্যাসিক জুড়ে রয়েছে। যারা কখনও হারার আগে হারতে শেখেনি, লড়াই থেকে পিঠটান দেওয়ার অভ্যাস করেনি, ভয়ডর দূরে ফেলে কেবল তারাই পারে ওভাবে শাহিন আফ্রিদিকে পরপর তিন ছক্কা হাঁকাতে। তারাই পারে ম্যাক্সওয়েল আউট হওয়ার পরের বলেই নতুন কেউ এসে সপাটে ছক্কা হাঁকাতে। এই অস্ট্রেলিয়াই পারে নকআউট স্টেজে এসে প্রতিপক্ষকে সটানে পাঞ্চ মেরে ভূপাতিত করতে। যেমনটা করেছে পাকিস্তানকে।

ফাইনালে ওঠার পর সংবাদ সম্মেলনে অসি কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার সেই পুরোনো অসি মেজাজই মনে করিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেট বিশ্বকে। 'আমরা সবসময়ই সাহসী ক্রিকেট খেলতে অভ্যস্ত এবং আমরা সেটা পছন্দও করি। যখন মার্কোস স্টয়নিস ম্যাক্সওয়েল আউট হয়ে যাওয়ার পরের বলেই শাদাব খানকে ছক্কা হাঁকাল, তখন সেটাকেই বলে ভয়ডরহীন ক্রিকেট।' বেশ গর্বের সঙ্গে এ কথা বলতে শোনায় ল্যাঙ্গারকে। 

একসময় এভাবেই ওয়ানডে ক্রিকেট খেলতেন মাইকেল বেভান, টম মুডি, রিকি পন্টিং, স্টিভ ওয়াহ, মাইক ওয়াহরা। প্রতিপক্ষ চারপাশ থেকে চেপে ধরার মুহূর্তে বুক চিতিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেন তারা। প্রচণ্ড স্নায়ুর চাপ সামলে পরের জনের অপেক্ষা না করে নিজেই দায়িত্ব নিতেন। চাপের মুহূর্তে নিজের ওপর দায়িত্ব নেওয়ার এই মানসিকতা সব দলের থাকে না। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালে যেটা ওয়ার্নার থেকে শুরু করে ম্যাথু ওয়েড পর্যন্ত করে দেখিয়েছেন। অসিদের এই ক্রিকেট বৈশিষ্ট্যের কথা জানা ছিল পাকিস্তানের ব্যাটিং কোচ ম্যাথু হেইডেনেরও। এজন্য ৮৬ রানে পাকিস্তানের ৫ উইকেট পরে যাওয়ার পরেও ডাগআউটে তাকে স্বস্তিতে বসে থাকতে দেখা যায়নি। 

আইসিসির টুর্নামেন্টে এখনও পর্যন্ত নক আউট পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পাঁচবার হেরেছে পাকিস্তান। তাই ম্যাচের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অন্তত কেউ বলতে পারেনি ম্যাচটি হেরে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। নিজেদের শেষ পর্যন্ত এই লড়াইয়ের মেজাজটাকেই সামনে এনেছেন ল্যাঙ্গার। এবারের বিশ্বকাপে টসে জেতা দলই ম্যাচ জিতে (১২ ম্যাচের মধ্যে ১১ জয় টসজয়ীদের)- সাংবাদিকদের টুকে রাখা তথ্যকণিকাকে উড়িয়ে দিয়ে তাই ল্যাঙ্গার বলেছেন, 'সংখ্যাতথ্যকে তো আর আমি মিথ্যা বলতে পারি না। তবে আমাদের মাইন্ডসেট বেশ পরিস্কার- আগে ব্যাটিং করি কিংবা পরে, যে কোনো পরিস্থিতিতেই আমরা ম্যাচ জিততে পারি। বাংলাদেশের বিপক্ষেই আমরা পরে ব্যাটিং করে ৭৪ রান তুলেছিলাম মাত্র ৬.২ ওভারে।'

নিজেদের মধ্যকার সেই 'ক্ল্যাসিক মেজাজটাই' যেন তুলে ধরলেন ল্যাঙ্গার। নিউজিল্যান্ড তাদের প্রতিবেশী বন্ধু, সেটা বলেও জানিয়ে দিলেন ফাইনালের জন্য প্রস্তুত তার দল। প্রথমবারের মতো টি২০ বিশ্বকাপ জেতার সুবর্ণ সুযোগ কোনোমতেই হাতছাড়া করবেন না ওয়ার্নার-ফিঞ্চরা।