তাসমান সাগরের এক পাড়ে সবুজ ছাওয়া পাহাড়ে ঘেরা দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড। অন্য পাড়ে দ্বীপ-মহাদেশ অস্ট্রেলিয়া। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি তাসমান সাগরের দুই তীরের দেশ দুটি মুখোমুখি হচ্ছে রুক্ষ মরুর বুকে। দুবাইয়ে টি২০ বিশ্বকাপ ফাইনালে আজ দু'দলই মাঠে নামছে ইতিহাস গড়তে। এশীয় কন্ডিশনে পাকিস্তান-ভারত-ইংল্যান্ডের মতো ফেভারিটদের টেক্কা দিয়ে ওশেনিয়া অঞ্চলের দুই দেশ নামছে টি২০ বিশ্বকাপের প্রথম শিরোপার জন্য।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড উভয় দেশই দারুণ নাটকীয়তায় সেমির বাধা পেরিয়ে এসেছে। প্রথম সেমিতে হটফেভারিট ইংল্যান্ডকে নিশাম-মিচেলের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে উড়িয়ে দেয় কিউইরা। আরেক ফেভারিট পাকিস্তানকে অস্ট্রেলিয়া ছিটকে ফেলে ম্যাথু ওয়েড ঝড়ে। দুই প্রতিবেশীর শক্তি ও কৌশলও অনেকটা কাছাকাছি। তাদের খেলার ধরনও প্রায় একই রকম। তাই জমজমাট ফাইনালের প্রত্যাশা ক্রিকেটপ্রেমীদের।

আইসিসি ইভেন্টে সবচেয়ে সফল দল অস্ট্রেলিয়া। এখন পর্যন্ত মোট ১০টি আইসিসি ফাইনালে ৭টিতে জিতেছে তারা। এর মধ্যে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে রেকর্ড পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, টি২০ বিশ্বকাপে পুরোপুরি ব্যর্থ তারা। একবার ফাইনালে উঠলেও এখনও কুড়ি ওভারের বিশ্বকাপের শিরোপার দেখা পায়নি তারা। সে আক্ষেপ ঘোচানোর মিশন নিয়ে আজ নামবেন ফিঞ্চ-ওয়ার্নাররা। নিউজিল্যান্ড অবশ্য এই প্রথমবারের মতো টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে। গত কয়েক বছর ধরে আইসিসি ইভেন্টে দারুণ ধারাবাহিক কিউইরা এ বছরই প্রথম ট্রফির দেখা পেয়েছে। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা হাতছাড়া হওয়ার যন্ত্রণা তারা লাঘব করেছে গত জুলাইয়ে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি জিতে। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে আরও একটি শিরোপা জেতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কেন উইলিয়ামসনরা। চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে ৫০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির জন্য ইতিহাস হবে। তাই তো ফাইনাল নিয়ে রোমাঞ্চিত কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন, 'টি২০ বিশ্বকাপ জিততে পারাটা অনেক বড় অর্জন হবে। আমাদের সামনে আরেকটা সুযোগ এসেছে। সেটা কাজে লাগাতে দলের সবাই মুখিয়ে আছে।' এই শিরোপার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়াও। অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চের কণ্ঠে সেটাই ফুটে উঠেছে, 'প্রত্যাশার চাপকে অস্বীকার করছি না। শিরোপা জয়ের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এখানে এসেছি এবং আমাদের স্কোয়াডের সে আত্মবিশ্বাস আছে।'

কুড়ি ওভারের ফরম্যাটে দুই দলের সামগ্রিক লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে থাকলেও বিশ্বকাপে একমাত্র মোকাবিলায় জয় পেয়েছিল নিউজিল্যান্ড। তবে বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাস আবার ভিন্ন। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পাত্তাই পায়নি কিউইরা। আজকের ফাইনালে লড়াইটা হতে পারে নিউজিল্যান্ডর বোলিংয়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ের। শিরোপা জিততে হলে কিউই ব্যাটারদেরও জ্বলে উঠতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কিউই ওপেনার মার্টিন গাপটিলের রেকর্ড বেশ ভালো। সেমিতে জীবনের সেরা ইনিংস খেলা তার পার্টনার ড্যারিল মিচেল দারুণ ছন্দে রয়েছেন। তবে নিউজিল্যান্ড ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় ভরসা কেন উইলিয়ামসন এখনও ব্যাট হাতে তেমন কিছু করতে পারেননি। ফাইনালের মঞ্চে তাকে জ্বলে উঠতে হবেই। তিনি ব্যর্থ হলে ঝামেলায় পড়ে যাবে কিউই ব্যাটিং। কারণ, মিডল অর্ডারে হাল ধরার কথা যার, সে ডেভন কনওয়ে সেমিতে আউট হওয়ার দুঃখে বোকার মতো ব্যাটে ঘুসি মেরে ছিটকে গেছেন। তার বদলে আজকের ফাইনালে নামবেন টিম সেইফার্ট।

অস্ট্রেলিয়ার সফলতাও দুই তারকা ওপেনার অ্যারন ফিঞ্চ ও ডেভিড ওয়ার্নারের ওপর অনেকটা নির্ভর করছে। পাওয়ার প্লেতে দুরন্ত ছন্দে থাকা দুই কিউই পেসার ট্রেন্ট বোল্ট ও টিম সাউদিকে তারা কীভাবে সামলান, সেটার ওপরই ইনিংসের গতিপথ নির্ভর করবে। আরেক কিউই পেসার অ্যাডাম মিলনেও দারুণ বোলিং করছেন। সে সঙ্গে মাঝের ওভারগুলোতে লেগস্পিনার ইশ সোধিও কার্যকর ভূমিকা রাখছেন। অবশ্য কিউইদের পেলেই জ্বলে ওঠেন ফিঞ্চ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫১ রান এসেছে তার ব্যাট থেকে। আর শেষ দুই ইনিংসে ওয়ার্নারও স্বরূপে ব্যাট চালিয়েছেন। তবে তাদের দুই অভিজ্ঞ গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ও স্টিভেন স্মিথ এখনও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। পাকিস্তানের বিপক্ষে মার্কাস স্টয়নিস ও ম্যাথু ওয়েড অভাবনীয় ব্যাটিং করে তাদের ব্যর্থতা ঢেকে দিলেও ফাইনালে কিন্তু তাদের জ্বলে উঠতেই হবে। না হলে বড় বিপদে পড়বে অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার বোলিং ত্রাস ছড়াতে না পারলেও প্রয়োজনটা ঠিকই মেটাচ্ছে। তিন পেসার মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স ও জস হ্যাজেলউড ভালোই করছেন। তবে মাঝের ওভারগুলোতে কিউইদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে স্পিনার অ্যাডাম জাম্পাকে সামলানো। ১২ উইকেট নেওয়া এ লেগি দারুণ ছন্দে আছেন।

সবকিছু ছাপিয়ে ফাইনালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে টস। শিশিরের কারণে এবারের বিশ্বকাপে অধিকাংশ ম্যাচ টসজয়ী দল জিতেছে। সে হারটা আবার দুবাইয়ে সবচেয়ে বেশি। এখানে গত ১২ ম্যাচের মধ্যে ১১টিতেই পরের ব্যাট করা দল জিতেছে। তাই আজ টসজয়ী দল নিশ্চিতভাবেই ফিল্ডিং নেবে। যদিও অসি অধিনায়ক ফিঞ্চ টসকে নিয়ন্তা মনে করছেন না। তার পরও মনের কোণে টস একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবেই কাজ করবে।