করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার বাড়লেও উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিশ্বের পাশাপাশি দেশের বাজারেও রয়েছে প্রযুক্তি পণ্যের সংকট। এই সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দেশে আনছেন আমদানি নিষিদ্ধ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শীর্ষ ব্র্যান্ডের রিফারবিশড (ত্রুটিযুক্ত পণ্য বিক্রির জন্য পুনরায় প্রস্তুত করা), পুরোনো ও নকল পণ্য। পাশাপাশি মোবাইল ফোনের মার্কেটে মিলছে শীর্ষ ব্র্যান্ডের নকল হ্যান্ডসেট ও যন্ত্রাংশ। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, চাহিদা ও জোগানের ব্যাপক ফারাক থাকার কারণে দেশের কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন মার্কেটে চলছে নকল ও পুরোনো পণ্যের রমরমা বাণিজ্য।

আমদানিনীতি ২০১৮-২০২১-এ ২১ ক্যাটাগরির পণ্যকে আমদানি নিষিদ্ধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রিকন্ডিশন্ড অফিস ইক্যুইপমেন্ট ক্যাটাগরিতে পুরোনো ফোন, পুরোনো কম্পিউটার ও কম্পিউটার সামগ্রী, ফটোকপিয়ার, ফ্যাক্স, টাইপরাইটার, টেলেক্স, পুরোনো ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিফারবিশড, নকল ও পুরোনো পণ্য দেশে আমদানি করছেন প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ীদের একটি অংশ।

জানা গেছে, রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ইসিএস কম্পিউটার সিটি, সুবাস্তু আর্কেড, আগারগাঁওয়ের আইডিবিতে রিফারবিশড, ব্যবহূত ল্যাপটপ, ক্লোন পিসি, মাদারবোর্ড, প্রিন্টার, স্ক্যানার প্রভৃতি কম্পিউটার পণ্য বিক্রি করে এমন দুই ডজনেরও বেশি দোকান রয়েছে। এ ছাড়া বিভাগীয় এবং জেলা শহরের দোকানেও পাওয়া যাচ্ছে রিফারবিশড ও পুরোনো কম্পিউটার পণ্য এবং নকল কম্পিউটার যন্ত্রাংশ। কম্পিউটার যন্ত্রাংশের মধ্যে নামি ব্র্যান্ডের মাউস, কিবোর্ড, মাউস প্যাড, কেবলের মতো নকল পণ্য বেশি পাওয়া যাচ্ছে। নির্মাতা কোম্পানি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে এমন আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যও দেশের বাজারে আনছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইসিএস কম্পিউটার সিটির সুমাইয়া টেলিকমে ক্রেতা সেজে খোঁজ নিলে জানানো হয়, তাদের স্টকে আমদানি করা ডেল ও এইচপির ব্যবহূত বেশ কিছু ল্যাপটপ রয়েছে। বাজার মূল্যের চেয়ে বেশ কম দামে এসব ল্যাপটপ বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে দেশের মোবাইল ফোন মার্কেটে দেদার বিক্রি হচ্ছে নকল পণ্য। এর মধ্যে নামমাত্র মূল্যে স্বল্প পাওয়া যাচ্ছে আইফোন ও স্যামসাংয়ের মতো শীর্ষ ব্র্যান্ডের নকল ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোন! পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে নকল মেমোরি কার্ড, হেডফোন, ব্লুটুথ এয়ারফোন, ব্যাটারি, চার্জার, ক্যাসিংসহ স্মার্টফোনের বিভিন্ন অ্যাকসেসরিজ।

রাজধানীর বিভিন্ন মোবাইল ফোনের মার্কেটে পাওয়া যাচ্ছে অ্যাপল ও স্যামসাং ব্র্যান্ডের নকল ফ্ল্যাগশিপ ফোন। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মেও পাওয়া যাচ্ছে এসব নকল ফোন! সেলবাজার ডটকমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে এক লাখ ৩০ টাকা দামের স্যামসাংয়ের গ্যালাক্সি এস২১ আলট্রা ফোন। ওই বিজ্ঞাপনে মোতালেব প্লাজার ঠিকানা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ঢাকার মধ্যে হলে সরাসরি দোকানে গিয়ে ডেলিভারি নিতে হবে। তাদের দেওয়া ফোন ০১৭২৫০২৯৮১৬ নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, তারা অরিজিনাল ফোন বিক্রি করছেন। লকডাউনের পর সরাসরি দোকানে উপস্থিত হয়ে দেখেশুনে যত খুশি ফোন নিতে পারবেন।

বিক্রি সহজ ডটকম নামের একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২০ আলট্রা মাস্টার কপি নামের হ্যান্ডসেটটির দাম দেওয়া হয়েছে মাত্র ৮ হাজার টাকা। হুবহু স্যামসাংয়ের গ্যালাক্সি এস২০ আলট্রা ফোনের মতো দেখতে হলেও এটি নকল ফোন। আইফোন ১২ ম্যাক্স প্রোর (সুপার কপি) দাম দেওয়া আছে ১২ হাজার টাকা।

ভুক্তভোগীর বক্তব্য: দেশে ক্যানন পণ্যের একমাত্র আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জেএএন অ্যাসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ এইচ কাফি সমকালকে বলেন, 'এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী স্বাস্থ্যহানিকর এবং ক্ষতিকর জেনেও আমদানি নিষিদ্ধ রিফারবিশড ও পুরোনো পণ্য দেশে ঢোকাচ্ছেন, আসছে নকল পণ্যও। ক্যাননেরই রিফারবিশড প্রিন্টার ও স্ক্যানার প্রচুর আসছে। মূল নির্মাতা কোম্পানি কিংবা অথরাইজড পরিবেশক কখনোই রিফারবিশড কিংবা পুরোনো পণ্য বিক্রি করবে না। কাজটি করে থাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাদের জন্য আমরা যারা সততার সঙ্গে ব্যবসা করতে চাই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হই। ক্রেতারাও বিভ্রান্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়।' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ইসিএস কম্পিউটার সিটির এক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা নেটওয়ার্কিং পণ্য বিক্রি করি। অনেক ক্রেতাই আমাদের কাছে ল্যাপটপ-কম্পিউটার চায়। কয়েকজন নিয়মিত ক্রেতার অনুরোধে ইসিএস কম্পিউটার সিটির এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিছু ল্যাপটপ-কম্পিউটার এনে বিক্রি করি। পরে ক্রেতারা অভিযোগ নিয়ে এলে বুঝতে পারি, সব ছিল রিফারবিশড পণ্য! ক্রেতার আস্থা ধরে রাখতে ওয়ারেন্টিসহ বিক্রয়োত্তর সেবা দিতে গিয়ে আট লাখ টাকা লস হয়। আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য কিনে এত টাকা গচ্চা দিলেন কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করছেন না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের তো ব্যবসা করে খেতে হবে। ওই কোম্পানি এবং তাদের সিন্ডিকেট অত্যন্ত শক্তিশালী। তাদের কাছে পরিবেশকরাও অসহায়। রাজধানীর একটি বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবী তানভির আহমেদ বলেন, ছেলের পড়াশোনার জন্য তিনি ইসিএস কম্পিউটার সিটির সুমাইয়া টেলিকম থেকে একটি ডেল ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ কেনেন। বাসায় নিয়ে গেলে বুঝতে পারেন সেটি ছিল পুরোনো! আশরাফ নামে এক তরুণ মোতালেব প্লাজা থেকে ১২ হাজার টাকায় সর্বশেষ মডেলের একটি আইফোন কেনেন। এত কম টাকায় কীভাবে নতুন আইফোন কিনলেন, এটা তো আসল না- এমন এক প্রশ্নের জবাবে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, নকল আইফোন বলেই তো এত কমে পাইছি। আসল হলে কি আর দিত! জেনেবুঝেই নকল আইফোন কিনেছি।

প্রতিরোধে করণীয়: সংশ্নিষ্টরা বলছেন- নকল, পুরোনো ও রিফারবিশড পণ্য আমদানি বন্ধে দেশে যুগোপযোগী নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালা সঠিকভাবে পরিপালিত হলে অবৈধ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব পণ্য দেশে ঢুকবে না। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, কাস্টমস এবং প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ীদের সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হতে হবে। নকল ও অবৈধ পণ্য বিষয়ে ব্যবসায়ী এবং ক্রেতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, মার্কেটগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে।

দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রযুক্তি পণ্যের আমদানিকারক স্মার্ট টেকনোলজিসের মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়) জাফর আহমেদ বলেন, আমরা শতাধিক প্রযুক্তি ব্র্যান্ডের পণ্য দেশের বাজারে দিচ্ছি। শতভাগ আসল পণ্য নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিটি প্রোডাক্টের মোড়কে স্মার্ট টেকনোলজিসের স্টিকার লাগিয়ে দিই। এতে ক্রেতারা সহজেই বুঝতে পারেন এটা অরিজিনাল পণ্য। পণ্যের ওয়ারেন্টি, সিরিয়াল নাম্বার, আমদানিকারক এসব যাচাই করলে পণ্যের আসল-নকল সম্পর্কে সহজেই ধারণা পাওয়া যায়। প্রযুক্তি পণ্যের ক্রেতারা কিন্তু এখন অনেক সচেতন উল্লেখ করে তিনি বলেন, জেনেবুঝে নকল কিংবা রিফারবিশড পণ্য কিনবে সংখ্যায় এরকম খুব কম। মূলত অরিজিনাল পণ্যের চেয়ে বেশ কম দামে পাওয়া যাওয়ায় জেনে বুঝে অনেকেই এসব পণ্য কিনে থাকেন।

স্যামসাং নকল পণ্যের বিষয়ে অবহিত কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে স্যামসাং বাংলাদেশের হেড অব মোবাইল মূয়ীদুর রহমান সমকালকে বলেন, স্যামসাং সকল পণ্যের সঙ্গে অফিসিয়াল ওয়ারেন্টি প্রদান করে; পাশাপাশি স্যামসাংয়ের প্যাকেজিংয়ের ওপর ওয়ারেন্টি স্টিকার থাকে। এ ছাড়া আসল হ্যান্ডসেট নিশ্চিত করতে স্যামসাং প্যাকেজিংয়ে বিটিআরসি অনুমোদিত যোগাযোগের নম্বরও দেওয়া থাকে। নকল পণ্য কিনে না ঠকতে ক্রেতাদের যাচাই করে নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সংশ্নিষ্টরা যা বলছেন: বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি শাহীদ উল মুনীর রিফারবিশড ও নকল পণ্য বাজারে রয়েছে স্বীকার কলে বলেন, আমরা বিক্রেতা-ক্রেতা উভয় পর্যায়ে সচেতন করতে কাজ করছি। যারা অবৈধ পণ্য আমদানি ও বিক্রি করে তারা মূলত আমাদের সমিতিভুক্ত সদস্য না। তবে আমাদের সমিতির হোক বা না হোক যেই অবৈধ পণ্যের ব্যবসা করুক আমরা প্রমাণ পেলে প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে ব্যবস্থা নেব।

একাধিক টার্মে কম্পিউটার সমিতির দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সভাপতি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সমকালকে বলেন, 'বৈধভাবে নকল, রিফারবিশড কিংবা ব্যবহূত পণ্য আমদানির একেবারেই সুযোগ নেই। অথচ বাইরে থেকে এসব পণ্য দেশে ঢুকছে। কাজেই এখানে কাস্টমসের ব্যর্থতা অস্বীকারের উপায় নেই। রাজস্ব বোর্ডও এসব বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অবৈধ মোবাইল হ্যান্ডসেট বন্ধে আমরা নিবন্ধন কার্যক্রম (এনইআইআর) শুরু করেছি। আশা করছি দ্রুত নকল সেট আমদানি ও ব্যবহার বন্ধ হবে। কিন্তু অবৈধ এবং নকল কম্পিউটার ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশ এবং মোবাইল ফোনের অ্যাকসেসরিজের আমদানি বন্ধে সংশ্নিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠন এবং রাজস্ব বোর্ডকে ভূমিকা রাখতে হবে। প্রয়োজনে আমরা সহযোগিতা দেব।'

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (শুল্ক্ক নীতি ও আইসিটি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া সমকালকে জানান, 'নকল, ব্যবহূত কিংবা রিফারবিশড আইটি পণ্য দেশে আমদানি নিষিদ্ধ। এ ধরনের পণ্য যদি কেউ দেশের বাজারে অবৈধ পথে আমদানি করে থাকে তবে প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'