- প্রযুক্তি
- বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণে রুশ প্রস্তাবে নানা ঝুঁকি
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণে রুশ প্রস্তাবে নানা ঝুঁকি

কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ ও উৎক্ষেপণের রুশ বেসরকারি কোম্পানি গ্লাভকসমস বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণে চুক্তির আগ্রহ দেখিয়ে সমঝোতা স্মারক করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে এর আগে দুবার কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় বাংলাদেশ পক্ষকে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হচ্ছে। যদিও এখন নিষেধাজ্ঞা নেই, তবু একবার যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ছায়া পড়লে সেই কোম্পানির সংশ্নিষ্টতা বাণিজ্যের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদের কাছে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, রাশিয়ার কোম্পানি গ্লাভকসমসের কাছ থেকে একটি সমঝোতা স্মারকের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। কোম্পানিটির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ছিল কিনা, তা জানা নেই।
সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে এই কোম্পানির সঙ্গে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে নিষেধাজ্ঞার সংকটে পড়েছিল ভারতের মহাশূন্য গবেষণা সংস্থা ইসরো। ফলে এই কোম্পানির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণের চুক্তি হলে তা বাংলাদেশকেও একই ধরনের নিষেধাজ্ঞার সংকটে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন সংশ্নিষ্টরা।
অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর জন্য রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ ভাড়া নেওয়ার কারণেও সম্ভাবনা থাকা কয়েকটি দেশে সক্ষমতা (ক্যাপাসিটি) বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানিয়েছে সংশ্নিষ্ট সূত্র। এর কারণ, ইন্টারস্পুটনিক বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর সক্ষমতা বিক্রির জন্য ১৪টি দেশে আন্তঃসমন্বয় চুক্তি থাকার কথা বললেও কোম্পানিটির চুক্তি আছে মাত্র ছয়টি দেশের সঙ্গে। আটটি দেশের সঙ্গে চুক্তি নেই।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৯২ সালে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি নির্বাহী আদেশে 'মিসাইল স্যাঙ্কসন ল'র আওতায় বিদ্যমান নীতিমালার সঙ্গে রাশিয়ার মহাশূন্য কোম্পানি গ্লাভকসমসের কার্যক্রম সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালে এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়। আবার ১৯৯৮ সালে একইভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়। নিষেধাজ্ঞা থাকা অবস্থায় অন্য কোনো দেশ চুক্তি করলে সে দেশের সংশ্নিষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার শর্ত প্রযোজ্য হবে- এমন অনুচ্ছেদও আদেশে যুক্ত করা হয়। ২০১০ সালে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়।
২০১৪ সালে টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি খবরে বলা হয়, ইসরো রাশিয়ার গ্লাভকসমসের সঙ্গে একটি জিওসিগ্ধেক্রানাস স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। পূর্ব নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ এ স্যাটেলাইট দিয়ে পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম চালাতে আপত্তি জানায়। পরে ভারতের ইসরো নিজস্ব সাইরোজেনিক ইঞ্জিন ব্যবহারের মাধ্যমে ওই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের একবার নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া চীন-রাশিয়ার কোম্পানিগুলোকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরও ধারাবাহিকভাবে চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়। ইসরোর প্রকল্পের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। বঙ্গবন্ধু-২ হবে 'অপটিক্যাল ভিএইচআর-সার' (সিনথেটিক অ্যাপারচার রাডার) সমন্বিত ক্যাটাগরির। এর মূল কাজ হবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভূমি এবং সমুদ্র এলাকার ছবি তোলা। ফলে পূর্ব নিষেধাজ্ঞার কারণে ওই রুশ কোম্পানির তৈরি যে কোনো স্যাটেলাইট দিয়ে অনেক দেশই ছবি তুলতে দেবে না। বিশেষ করে মার্কিন কাটসা (কাউন্টারিং আমেরিকাস অ্যাডভারসারিজ থ্রু স্যাঙ্কসন অ্যাক্ট) নীতিমালা সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় দেখিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকা অঞ্চলের দেশগুলো নিজেদের ভূখণ্ড এবং সমুদ্রসীমার ছবি তুলতে না দেবে না এমন বড় ঝুঁকি রয়েছে।
জানা গেছে, গ্লাভকসমসের কাছ থেকে সমঝোতা স্মরকের যে প্রস্তাব এসেছে, তার একটি বড় অংশ রুশ ভাষায় লেখা। প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে এটাও বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর। বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানির নিয়োগ করা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়েদারহাউসকুপারসের প্রতিবেদনে রুশ প্রতিষ্ঠানের যে সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ আছে, তা পশ্চিম ইউরোপের কোনো দেশের কোম্পানির নেই বলেও তথ্য-প্রমাণসহ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, আন্তঃসমন্বয় চুক্তি সম্পর্কে ইন্টারস্পুটনিকের অনির্ভরযোগ্য তথ্যের অভিযোগটির কারণে ইন্দোনেশিয়াসহ আশপাশের কয়েকটি দেশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বড় সম্ভাবনা থাকলেও তা সফল হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কাটসা নীতিমালার কারণে এই দেশগুলো রাশিয়ার কোনো কোম্পানির সঙ্গে কো-অর্ডিনেশন চুক্তিতেও যেতে চায় না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, যদি রাশিয়ার কোম্পানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মতো কোনো ঘটনা থাকে, তাহলে সেটা অবশ্যই বিবেচনার বিষয়। কিন্তু এ-সংক্রান্ত তথ্য এখন পর্যন্ত তাদের কাছে নেই। বিষয়টি নিয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর সক্ষমতা বিক্রি-সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, এখন ৪০ শতাংশ সক্ষমতা বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে এবং এটি দেশের বাজারে। বিদেশের বাজারে বিক্রি না হওয়ার কারণ ইন্টারস্পুটনিকের কক্ষপথ সমস্যা নয়, বরং দামের বিষয়টিই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এখন অভ্যন্তরীণ বাজারেই আরও বেশি সুযোগ খোঁজা হচ্ছে। তিনি আশা করেন, দেশের ভেতরেই আরও ৪০ শতাংশ সক্ষমতা বিক্রি সম্ভব হবে।
মন্তব্য করুন