হাজার কোটি ডলারের বেশি খরচে নির্মিত জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের (জেডব্লিউএসটি) প্রথম পাঠানো ছবি এরই মধ্যে প্রকাশ করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এই টেলিস্কোপ সংস্থাটির হাবল টেলিস্কোপকে প্রতিস্থাপন করবে- এমন গুঞ্জনও রয়েছে। তবে বিশাল আকারের ছায়াপথগুলোর বিবর্তন আর কাঠামো পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী লামীয়া মওলা বলছেন, বিষয়টি এত সরল নয়। হাবল এখনও গুরুত্বপূর্ণ।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ প্রকল্পে কাজ করা লামীয়া ২০২০ সালে ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করেছেন। এখন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কাজ করছেন ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর ডানলাপ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে। সে কাজের সুবাদেই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ প্রকল্পে হাজার বিজ্ঞানীর দলে যুক্ত হয়েছেন।

কারিগরি গঠন বিবেচনায় নিলে টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব আর হাবল একেবারেই ভিন্ন। পার্থক্য আছে অবস্থানেও। হাবলের আয়না আকারে ২.৪ মিটার, ওয়েব টেলিস্কোপের আয়না ৬.৬ মিটার। অর্থাৎ, হাবলের চেয়ে জেমস ওয়েবের আলোকরশ্মি গ্রহণ করার সক্ষমতা অনেক বেশি। তবে দুটি টেলিস্কোপের মধ্যে তুলনা বিচার ঠিক যৌক্তিক নয় বলেই ফোর্বস সাময়িকীকে জানিয়েছেন লামীয়া।

হাবল মানব চোখে দৃশ্যমান আলোকরশ্মিতেই মহাবিশ্ব দেখে। তবে জেমস ওয়েব মূলত ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ, সাধারণ পরিস্থিতিতে আলোর তরঙ্গের যে অংশ মানব চোখে দৃশ্যমান নয়, তা বিশ্নেষণের ভিত্তিতেই মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছে এটি।
উভয় টেলিস্কোপের মূল কাজ মহাবিশ্ব নিয়ে হলেও টেলিস্কোপ দুটি মহাকাশকে পর্যবেক্ষণ করছে কার্যত ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। দুটি টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণ থেকে আসা তথ্যেও আছে বড় পার্থক্য।

হাবল পৃথিবীকে চক্কর দেয় বলে টেলিস্কোপটিতে গিয়ে ছোটখাটো সংস্কারকাজ করতে পেরেছিলেন নাসার নভোচারীরা। সে সুযোগ নেই জেমস ওয়েবের ক্ষেত্রে। সক্ষমতার বিচারে জেমস ওয়েব বেশি শক্তিশালী, তাই বিজ্ঞানীদের কাছেও এ মুহূর্তে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। জেমস ওয়েবের উপস্থিতিতে হাবল নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে চাহিদা একটু কমলেও পুরোনো টেলিস্কোপটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে, তা ভাবলে ভুল হবে।

লামীয়ার নিজের গবেষণা প্রকল্প 'থ্রিডি-ড্যাশ'-এর অংশ হিসেবে ইনফ্রারেডের কাছাকাছি তরঙ্গে মহাকাশের ছায়াপথগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হাবল টেলিস্কোপের লেগেছে আড়াইশ ঘণ্টা। লামীয়া বলেন, থ্রিডি-ড্যাশ প্রোগ্রাম হাবলের মহাকাশের বড় একটা অংশে ছবি তোলার সক্ষমতার ঐতিহ্যকেই সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেন আমাদের ছায়াপথের বাইরে ছায়াপথগুলোর রহস্য উদ্ঘাটন শুরু করতে পারি।

গত মাসেই 'দি অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নাল'-এ প্রকাশিত হয়েছে থ্রিডি-ড্যাশ নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন। এর সহ-রচয়িতা ছিলেন লামীয়া। মহাকাশের যে অংশগুলোতে নতুন নক্ষত্রের গঠন হচ্ছে, 'থ্রিডি-ড্যাশ'কে তার ম্যাপ বলে আখ্যা দিচ্ছেন লামীয়া। এর মাধ্যমে মহাকাশের বিরল বস্তুগুলোর খোঁজ করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। এরপর জেমস ওয়েবের মাধ্যমে আরও খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণও সম্ভব হবে।

হাবল অতিবেগুনি রশ্মি এবং মানব চোখে দৃশ্যমান আলোতে মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করলেও দীর্ঘ ইনফ্রারেড তরঙ্গে ছবি তোলে জেমস ওয়েব। লামীয়া বলেন, মূল পার্থক্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি, যা হাবলকে প্রাসঙ্গিক রাখবে, সেটি হলো হাবল আলট্রাভায়োলেট থেকে 'নিয়ার ইনফ্রারেড' আলো পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে পারে। জেমস ওয়েব 'নিয়ার ইনফ্রারেড' থেকে ইনফ্রারেড তরঙ্গের মাঝামাঝি পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। এর মানে জেমস ওয়েব অতিবেগুনি এবং দৃশ্যমান আলো পর্যবেক্ষণ করে না। যদি অতিবেগুনি রশ্মি আর দৃশ্যমান আলোতে কিছু পর্যবেক্ষণ করতে চাই, তবে আমাদের হাবলের কাছেই ফেরত যেতে হবে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাবিশ্বের যে ছবিগুলো তোলা সম্ভব হবে, তার সবই নির্ভর করবে হাবল থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর। লামীয়া বলেন, হাবলের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই আমাদের সব লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে- আর ওয়েব এখন এতে আরও বেশি তথ্য যোগ করবে। হাবল এখানে খুব, খুবই গুরুত্বপূর্ণ।