মহাকাশযান ভয়েজারের মাধ্যমে মহাকাশে পৃথিবীর ১১৫টি ছবি পাঠানো হয়েছে। উচ্চবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো প্রাণ কখনও এর সন্ধান পেলে পৃথিবী সম্পর্কে যেন ধারণা করতে পারে, সে ভাবনা থেকে এ পদক্ষেপ নেওয়া। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রী অ্যানসেল অ্যাডামসের দুটি ছবি স্থান পেয়েছে এর ভেতর। নাসার ওয়েবসাইটে এ তথ্য প্রকাশিত।
স্ট্রিট ফটোগ্রাফির পথিকৃৎ ও আলোকচিত্রীদের আন্তর্জাতিক সমবায় প্রতিষ্ঠান ম্যাগনাম ফটোজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফরাসি আলোকচিত্রী অঁরি কার্টিয়ের ব্রেঁসো বলেছেন, 'পৃথিবী যদি টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকে তখন এর সব পাথর আর গাছ হলো অ্যানসেল অ্যাডামস ও এডওয়ার্ড ওয়েস্টনের ছবিগুলো।' অ্যাডামস এবং ওয়েস্টনের আলোকচিত্রকে পৃথিবীর সব আলোকচিত্রের মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য করেছেন তিনি। ১৯০২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সান ফ্রান্সিসকোর ফিলমোরে জন্ম নেওয়া এ আলোকচিত্রী পৃথিবীর সেসব আলোকচিত্রীর মধ্যে একজন, যাঁদের অবদান ছাড়া আলোকচিত্রশিল্প বিলীন হয়ে যেতে পারত।
আলোকচিত্রশিল্পে নতুন প্রযুক্তির আবিস্কারক অ্যানসেল অ্যাডামস। ১৯৩৯-৪০ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের আর্ট সেন্টার স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় অ্যানসেল অ্যাডামস ও ফ্রেড আর্চার মিলে 'জোন সিস্টেম' আবিস্কার করেন। হার্টার-ড্রিফিল্ডের সংবেদনশীলতার গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এই সিস্টেম তাঁরা উদ্ভাবন করেন। ধরা যাক একটি ছবিতে আকাশে উজ্জ্বল সূর্য থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল আকাশ, পাহাড়, গাছ, বাড়ি, মাঠ, অন্ধকার বন- সব উপাদান রয়েছে। ছবিটা যদি সাদা কালো হয়, সেটি প্রিন্ট করার সময় সব উপাদানের রঙের ব্যালান্স ঠিক রাখার অনবদ্য একটি পদ্ধতি এই 'জোন সিস্টেম', যার মাধ্যমে সূর্য অতিরিক্ত উজ্জ্বল হয়ে ঝলসে যাবে না, কিংবা ঘন বন একেবারে কালো হয়ে যাবে না। ফিল্ম এক্সপোজ করা, নেগেটিভ ডেভেলপ করা এবং ছবি প্রিন্ট করার সময় কাঙ্ক্ষিত টোন পাওয়ার উপায় এটি। শুধু ফিল্ম ক্যামেরার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রযোজ্য। এ পদ্ধতিতে একটা ছবিকে ১১টা অংশে ভাগ করা হয়। প্রথম ও শেষ অংশ নিখাদ কালো ও সাদা। মাঝে ধূসরের ৯টা মাত্রা। এ পদ্ধতিতে একটা ছবির নিখুঁত প্রিন্ট পাওয়া সম্ভব।
ছোটবেলায় অ্যানসেল অ্যাডামস ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন না এবং স্কুলে ছিলেন ভীষণ রকম অবাধ্য। তাঁর বাবা অ্যাডামসকে ১২ বছর বয়সে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু স্কুল থেকে নিয়ে আসার পরই অদ্ভুত এক ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। দেখা যায়, অ্যাডামসের স্বশিক্ষার ক্ষমতা অসাধারণ এবং নিজে তিনি অসামান্য একজন সংগীতশিল্পী হয়ে ওঠেন। বিখ্যাত সংগীতবিদ ও সুরকার হেনরি ক'য়েল অ্যাডামসকে প্রকৃতিগতভাবে প্রতিভাসম্পন্ন মনে করেন।
অ্যাডামস ১৯১৬ সালে তাঁর প্রথম ক্যামেরা হাতে পান। দেখা যায়, আলোকচিত্রেও তিনি অনন্য সাধারণ। তাঁর প্রথম ক্যামেরা ছিল কোডাকের ব্রাউনি মডেল বি বক্স ক্যামেরা। ১৯২০ সালে ইয়োসেমিতি জাতীয় উদ্যানের সিয়েরা ক্লাব লজের তত্ত্বাবধায়ক থাকাকালে অসাধারণ সব ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফ তৈরি করেন তিনি। অ্যাডামস পরিবেশবাদী ছিলেন। তাঁর পরিবার যখন আয়ারল্যান্ড থেকে অভিবাসিত হয়ে প্রথমে নিউ ইংল্যান্ড ও পরবর্তী সময়ে ক্যালিফোর্নিয়া গিয়ে থিতু হলো, তাঁর দাদা কাঠের ব্যবসা শুরু করে বেশ সমৃদ্ধি লাভ করলেন। অ্যাডামসের বাবা উত্তরাধিকারসূত্রে সেই ব্যবসার হাল ধরলেও, অ্যাডামস পারিবারিক জীবিকা থেকে সরে এসে চিরকাল এর সমালোচনা করে গেছেন। কারণ পূর্বসূরিদের এ ব্যবসা রেডউড বনের জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ।
প্রকৃতি ও প্রাণী বৈচিত্র্যের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন তিনি। বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফার তিনি। ১৯৮৪ সালের ২২ এপ্রিল ৮২ বছর বয়েসে মৃত্যুবরণকারী এ শিল্পী প্রায় ৪০ হাজার আলোকচিত্র রেখে গেছেন; লিখেছেন ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ।া

বিষয় : আলোর চিত্রকর স্ট্রিট ফটোগ্রাফি আলোকচিত্রশিল্প

মন্তব্য করুন