বিক্ষোভ দমন, রাজনৈতিক প্রতিবাদ মোকাবিলায় দেশে দেশে সরকারগুলো ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখে। ২০২২ সালে এ ধরনের ইন্টারনেট সেবা বন্ধের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম।

মঙ্গলবার প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা পর্যবেক্ষণ সংস্থা অ্যাক্সেস নাউ এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে।

সরকার বলছে, বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে সরকারি নির্দেশনায় ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটেনি।

প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছর ৩৫ দেশে সরকারিভাবে রেকর্ড ১৮৭ বার ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৩৩টি দেশে ২০১৬ সাল থেকে এই ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। ২০২১ সালে ৩৪, ২০২০ সালে ২৯ এবং ২০১৯ সালে ৩৩টি দেশে ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রতিবাদ মোকাবিলায় মূলত সরকারগুলো ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। এর ফলে জনমানুষের জীবনযাপন ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ কার হয়েছে।

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশ, ইরান, রাশিয়া, মিয়ানমারসহ ১৪টি দেশে ৪৮ বার ইন্টারনেট বন্ধের নথিভুক্ত করেছে অ্যাক্সেস নাউ। প্রতিবেদন অনুসারে ১৬টি দেশে ৬২ বার ইন্টারনেট বন্ধ হয়েছে বিক্ষোভের সময়। চলমান সংঘাতের সময় ৩৩ বার ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ ওঠার পর। গত বছর নির্বাচনকালে ৫টি দেশে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার ঘটনা ঘটে, ২০২১ সালে এমন দেশের সংখ্যা ছিল ১২টি। পরীক্ষায় সময় অনিয়ম রোধে ৬ দেশে গত বছর ৮ বার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। বাংলাদেশ, রাশিয়াসহ ২৩টি দেশে গতবছর ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মত ইন্টারনেটভিত্তিক ২৮টি পরিসেবা বন্ধ ছিল। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্টারনেট বন্ধে এককভাবে শীর্ষে রয়েছে ভারত। ২০২২ সালে দেশটির সরকার ৮৪ বার ইন্টারনেট ব্লাকআউট করেছে। এরমধ্যে কাশ্মীরের ভারতশাসিত অংশেই ৪৯ বার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। টানা ৫ বছর ধরে দেশটি এই তালিকার শীর্ষে আছে।

২০২২ সালে তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়িত ইউক্রেন। দেশটিতে মোট ২২ বার ইন্টারনেট সেবা বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। বাইরের শক্তির আক্রমণে ইন্টারনেটের ব্লাক আউটের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে ইন্টারনেট ব্যবহারে কঠোর সেন্সরশিপ ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তৃতীয় অবস্থানে আছে থাকা ইরান ২০২২ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় ১৮ বার সরকারি নির্দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২২ বছর বয়সী কুর্দি নারী মাহসা আমিনি পুলিশি হেফাজতে মারা গেলে ইরানে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হয়।

তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকা মিয়ানমারে ৭ বার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখে দেশটির সামরিক সরকার। দেশটির অনেক অঞ্চল গতবছর থেকে এ বছরের সালের মার্চ পর্যন্ত ৫০০ দিনেরও বেশি সময় ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

তালিকায় পঞ্চম স্থানে থাকা বাংলাদেশে গত বছর ৬ বার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়েছে।

জর্দান, লিবিয়া, সুদান ও তুর্কেমিনিস্তানে ৪ এবং আফগানিস্তান, বুরকিনা ফাসো, কিউবা, কাজাস্থান, রাশিয়া, সিয়েরালিয়ন, কাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানে গত বছর ২ বার করে ইন্টারনেট ব্লাক আউটের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আলজেরিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, ব্রাজিল, চীন, ইথোপিয়া, ইরাক, নাজেরিয়া, ওমান, পাকিস্তান, সোমালিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া, তিউনেশিয়া, তুরস্ক, উগান্ডা, ইয়েমেন এবং জিম্বাবুয়েতে ১ বার করে ইন্টার বন্ধ করা হয়।

অ্যাক্সেস নাউ এর প্রতিবেদন অনুসারে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ইন্টারনেট বন্ধ হয়েছে ইথিওপিয়ার তাইগ্রে অঞ্চলে। বিদ্রোহ চলমান থাকায় ইথিওপিয়ার সরকার প্রায় দুই বছর এই অঞ্চলকে প্রায় ইন্টারনেটহীন করে রেখেছে। এই বিচ্ছিন্নতার সময়ে এই অঞ্চলে জাতিগত নিধন, ধর্ষণ ও অত্যাচারের ঘটনা ঘটে। গত নভেম্বরে এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি সইয়ের পর তাইগ্রেতে ইন্টারনেট ও মোবাইল সংযোগ পুনরায় চালু করা হয়, তবে এখনও কিছু অঞ্চল এই সেবার বাইরে রয়েছে।

অ্যাক্সেস নাউ এর কর্মকর্তা ফেলেসিয়া অ্যান্তোনিও বলেন, সরকারগুলো ইন্টারনেট বন্ধকে জনতাকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার এবং নিজেদের নিরাপদ রাখার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ২০২২ সালে কর্তৃত্ববাদী এবং গণতান্ত্রিক উভয় ধরনের সরকার ব্যবস্থার অধীনেই এ ধরনের নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতালিপ্সুরা এই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত করে, দমনপীড়নের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করেছে।

এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বুধবার রাতে সমকালকে বলেন, গত কয়েক বছরে দেশে ইন্টারনেট বন্ধের কোনো ঘটনা ঘটেনি। কোনো এলাকায় লোক সমাগম বেশি হলে অনেকেই ঠিকমতো ইন্টারনেট পায় না। পদ্মাসেতুর উদ্বোধনের দিন সেতু এলাকায় গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়নি। অনেক সময় কারিগরি ত্রুটির কারণেও কোনো কোনো এলাকায় এমটি ঘটে থাকতে পারে।

তবে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে অনুষ্ঠিত বিএনপির গণসমাবেশের আগে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ বা গতি কমিয়ে দেওয়া অভিযোগ পাওয়া যায়। যদিও সে সময়ও সরকারের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। এর আগে ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর দুর্গা পূজার বিজয়া দশমীর দিন সারা দেশে উচ্চগতির থ্রিজি ও ফোরজি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকে। এর দুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়িয়ে কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা-ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। সে সময় ছয় জেলায় মোবাইল ফোনে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়েছিল।