প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা লইয়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অদ্যাবধি যে সকল কাণ্ড ঘটাইয়াছে; সেইগুলিকে কোনো প্রকারেই দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক বলা যায় না। প্রথমত, গত বৎসর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বাতিল হইবার পর কোনো পর্যায়ে যথাযথ কোনো আলোচনা ব্যতীত এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হইল–শিক্ষার্থীদের এত বড় একটা পাবলিক পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতির কোনো সুযোগ না দিয়া শুধু এক মাসের নোটিশে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। প্রথিতযশা শিক্ষাবিদগণ, তৎসহিত বহু শিক্ষক ও অভিভাবক কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শারীরিক-মানসিক ধকলের কথা ভাবিয়া সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাইলেও, তাহাতে কর্ণপাত করা হয় নাই। দ্বিতীয়ত, গত মঙ্গলবার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হইবার প্রায় দুই মাস পর উক্ত বৃত্তি পরীক্ষার যে ফল ঘোষণা করা হয়, উহা নানা ভুলত্রুটির কারণে মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার করা হয়। উক্ত ফলে দেখা গিয়াছিল, বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করিয়াও অনেক শিক্ষার্থী একেবারে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাইয়াছে। বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় কোনো কোনো স্কুলের মেধা তালিকার প্রথম কুড়িজনের নাম-নিশানা না থাকিলেও নিম্নদিকের অনেকেরই নাম আছে। এমনকি বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় নাম একজনের, কিন্তু রোল নম্বর আরেকজনের। অদ্ভুত বিষয়, বুধবার রাত্রিতে উক্ত পরীক্ষার যে সংশোধিত ফল প্রকাশিত হইয়াছে– উহাতেও শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদনে যেমনটা বলা হইয়াছে, ঐ সকল ত্রুটির প্রায় সকলই উপস্থিত। আমরা মনে করি, প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা গ্রহণ হইতে দুই দফায় ফল প্রকাশ পর্যন্ত যাহা ঘটিয়াছে, তাহা সংশ্লিষ্ট কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লইয়া এক প্রকার তামাশা; মন্ত্রণালয়সহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দায়িত্বশীল হইলে যাহা পরিহার করা যাইত। আমাদের এমনটা মনে করিবার কারণ, বিষয়টা শিশু-মনস্তত্ত্বের সহিত সরাসরি সম্পর্কিত এবং স্পর্শকাতরও বটে। একটা সময়ে মূলত অজ্ঞতাবশত শিশুদের পারিবারিক ও বিদ্যালয় পর্যায়ে ‘মানুষ করিবার’ প্রত্যয়ে শারীরিক ও মানসিক আঘাত প্রদান ছিল নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিশু–মনস্তত্ত্ববিষয়ক জ্ঞান যত বিকশিত হইয়াছে ততই শিশুর প্রতি সমাজ ও পরিবারে মানবিক আচরণের গুরুত্ব প্রাধান্য পাইয়াছে। বিশেষজ্ঞগণ এখন প্রায় একমত, শৈশবে শারীরিক তো বটেই, মানসিক কোনো আঘাত যে কাহারও ভবিষ্যৎ জীবনকে বিপর্যস্ত করিয়া দিতে পারে। গুরুজনের নিকট কোনো কারণে আপাত তুচ্ছ বকুনি কিংবা পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল না পাইয়া ইদানীং বহু শিশুর আত্মহননের সংবাদ তো মাঝেমধ্যেই দৃষ্টিগোচর হয়। প্রতিবেদনমতে, প্রথম তালিকায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিপ্রাপ্ত কন্যার দ্বিতীয় তালিকায় নাম না থাকার পর মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার এক অভিভাবক বলিয়াছেন– তাঁহার কন্যা এখন কিছুই খাইতেছে না, এমনকি বাঁচিতেও চাহিতেছে না; উহা নিছক কথার কথা নহে। ঐ অভিভাবক যে প্রশ্ন তুলিয়াছেন; কন্যার কোনো ক্ষতি হইলে দায়ভার কে লইবে– উহাও অত্যন্ত সংগত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উহাদের ভুলের কারণে শিক্ষার্থীদের মনে সৃষ্ট গভীর হতাশার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হইতে পারে, তাহা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতেছেন বলিয়া প্রত্যয় হয় না। নতুবা পুরা বিষয়টার জন্য গতানুগতিক কায়দায় ‘কারিগরি ত্রুটি’কে দায়ী করিয়া উহারা দায়মুক্তির প্রয়াস চালাইতেন না। সতর্ক থাকিলে কারিগরি ত্রুটি পরিহার কঠিন কিছু নহে। উপরন্তু কারিগরি ত্রুটি একবার ঘটিতে পারে। উহার পুনরাবৃত্তির অর্থ; ভুলটা কারিগরি নহে বরং কারিগরের। অর্থাৎ বিষয়টা যাঁহাদের তদারকি করিবার কথা তাঁহারা পূর্ণ দায়িত্বশীল হইলেই ভুলটা পরিহারযোগ্য।
আমরা মনে করি, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে উক্ত ত্রুটির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত এবং শিশুদের সহিত এহেন তামাশার হোতাদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। ভবিষ্যতে একই প্রকার ভুলের পুনরাবৃত্তি প্রতিহতকরণেও ইহা গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে সংশোধিত ফলে বাদ পড়া শিক্ষার্থীদের ফল যাচাইয়ের সুযোগ দিবার প্রতিশ্রুতিও যথাযথভাবে কার্যকর করিতে হইবে।