ডিজিটাল প্রযুক্তিতে জেন্ডার বৈষম্য নিরসন বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিশিষ্টজন। তাঁদের মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল মাধ্যমকে বাদ দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করা অসম্ভব। তাই এ প্ল্যাটফর্মকে সমতাভিত্তিক করার জন্য নীতিনির্ধারণ করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

বক্তারা বলেছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে অংশগ্রহণ এবং প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে টিকে থাকার জন্য সব নারীকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে মেধাবী এবং দক্ষ করে তুলতে হবে। অনলাইনে নিরাপদ বিচরণের জন্য জাতীয় থেকে তৃণমূল পর্যায়ে আইনের যথাযথ প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দৈনিক সমকালের সভাকক্ষে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলা হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল দৈনিক সমকাল।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে আলোচনায় বক্তব্য দেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা, সংসদ সদস্য আরমা দত্ত, নিজেরা করির কো-অর্ডিনেটর ও মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিবুজ্জামান, মানবাধিকার কমিশনের সদস্য কাওসার আহমেদ, পুলিশের উপমহাপরিদর্শক আমেনা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) পরিচালক হাবিবুল্লাহ নিয়ামুল করিম, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, এটুআই প্রোগ্রামের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ নাহিদ শারমিন, অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু, নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম এবং সাইবার টিনস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাদাত রহমান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ড. তানিয়া হক। স্বাগত বক্তব্য দেন সমকাল সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন।

শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে জেন্ডার বৈষম্য নিরসন করার জন্য প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনার অধিকারী এবং সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ধর্মগুরুদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। কেননা তাঁদের বাদ দিয়ে সমাজ এবং ধর্মের গতিবিধি সঠিক পথে আনা সম্ভব নয়। নারীরাও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়েন, তাঁরা কেন ওয়াজ করতে পারবেন না? তাঁরাও ওয়াজ করবেন। তাঁদেরও তাঁদের বক্তব্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে হবে। কেননা নারীরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার একাডেমিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারছেন। তাঁদেরও এগিয়ে আসতে হবে।


উপমন্ত্রী বলেন, ধর্মগুরুদের সচেতন করার মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। অনুরূপভাবে নারীদের কর্মক্ষেত্রে এবং ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রবেশের ক্ষেত্রেও ধর্মগুরুদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তাঁরা যেন এটা প্রচার না করেন যে, মেয়েদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দেওয়া যাবে না। এ ধরনের একটা ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে।  তিনি বলেন, অনেক নারী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে কর্মক্ষেত্রে আসছেন না। এটা সেই নারীর পরিবার এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। এ জন্য কর্মক্ষেত্রের পরিবেশকে নারীবান্ধব করে তুলতে হবে।

সেলিম রেজা বলেন, কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে প্রযুক্তিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এটি করা গেলে প্রযুক্তিতে ব্যাপকহারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এক সময় কিছু নারীকে জাপানে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথমে নারীদের জাপানে যেতে বললে তাঁরা আকাশ থেকে পড়েন।  তবে প্রথম এক নারীকে পাঠানোর পর তিনি সেখানে ভালো করেন, তখন আরও অনেক নারী আগ্রহী হন। তাঁরা এখন জাপানে গিয়ে খুব ভালো কাজ করছেন। অতএব, নারীদের প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে নারীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি চালু করা যেতে পারে। এতে তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়বে।

আরমা দত্ত বলেন, মেয়েদের সুরক্ষিতভাবে ক্ষমতায়ন করতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ক্ষেত্রে তাঁদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল পৃথিবীটা এখনও পুরুষ নিয়ন্ত্রিত। এ ক্ষেত্রে সবার মানসিক পরিবর্তন জরুরি। কেননা আমরা ভাবতেই পারি না যে, নারীরাও প্রযুক্তিতে আসতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কীভাবে নারীরা সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারেন– এটি আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

খুশী কবির বলেন, এখনও মনে করা হয় নারীরা বিজ্ঞান পারে না। দেখা যায় যে, বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে নারীদের সম্পৃক্ততা কম। এ বিষয়টি দূর করতে হবে। নারীদের বোঝাতে হবে যে, তাঁরাও পারবেন। তাহলে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে।

লাফিফা জামাল বলেন, বর্তমান যুগ হচ্ছে প্রযুক্তির। এ যুগে এগিয়ে যেতে হলে নারী-পুরুষ সবাইকেই প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে হবে। একই সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে। এটি না জানলে মেয়েদের ডিজিটাল ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে দিতে ভয় পাবেন অভিভাবকরা। এ জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

মোজাম্মেল হোসেন বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে নারী-পুরুষের ব্যবধান আমাদের সমাজের প্রগতিকে ব্যাহত করবে। এই ব্যবধান ঘুচিয়ে আনতে কী উদ্ভাবনমূলক কাজ করা উচিত তা ভাবতে হবে।

কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। এর কল্যাণে আমরা অনেক কাজ সহজেই করতে পারছি। শিল্প বিপ্লবে আমরা অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও আমাদের বর্তমান প্রযুক্তিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ জন্যে তথ্য-প্রযুক্তিতে নারী-পুরুষের সমান অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

মূল প্রবন্ধে তানিয়া হক বলেন, পরিবর্তনের শুরু হতে হবে আমাদের পরিবার থেকেই। ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও অধিকার দিতে হবে। পরিবার থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে, শিক্ষা ও গবেষণায় মেয়ে সন্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। দেশের ‘ডিজিটাল জেন্ডার গ্যাপ’ সম্পর্কিত গবেষণার পরিমাণ বাড়াতে হবে।