এক বিন্দুতে মিলে গেল শুরু আর শেষ। একদিন মেলবোর্নেই শুরু হয়েছিল সানিয়া মির্জার রূপকথা। ঠিক সেখানেই থামল তার গ্র্যান্ড স্ল্যাম যাত্রা। ফেব্রুয়ারিতেই নিজের টেনিস র‍্যাকেট পুরোপুরি তুলে রাখবেন তিনি। আর দেখা যাবে না র‍্যাকেটের কাব্য। ছন্দ তুলবে না কোনো প্রতি-আক্রমণ, ফোরহ্যান্ড শট।

সেরিনা উইলিয়ামস নামে যে মিথ সৃষ্টি হয়েছিল তা ১৮ বছর আগের এক ম্যাচে এই ফোরহ্যান্ডেই থমকে দিয়েছিলেন সানিয়া মির্জা। সেবারই প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যামকে নিজস্ব সম্পত্তি করেছিলেন তিনি। ভারত জানিয়েছিল, তাদেরও একজন বিশ্বসেরা আছেন। যা অবাক নজরে দেখেছিলেন মার্কিন কিংবদন্তি।

সেই ম্যাচের প্রথম রাউন্ড ৬-১-এ হেরেছিলেন সানিয়া। সবাই ভেবেই নিয়েছিলেন সেরেনা জিতবেন, একটু কষ্ট হলেও। তবে উজ্জ্বল নক্ষত্র হওয়ার জন্য যার শুরু, তিনি কি থেমে যাবে! সেই ম্যাচ শেষ হয়েছিল ৬-৪ এ।

এরপর ২০২৩। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন সানিয়া। সঙ্গে রোহন বোপান্না। সমাপ্তির খেলায় নিশ্চয় আনন্দের কান্নাই ছিল প্রত্যাশিত! তবে সব বিদায় কি প্রেমময় হয়? ব্রাজিলের স্টেফানি-মাতোসের কাছে থেমে গেল রথ। সানিয়া হেরে গেলেন।

আবেগ যেন উত্তাল ঢেউ হয়ে বেরিয়ে এলো সানিয়ার চোখে। কেঁদে ফেললেন হায়দরাবাদের কন্যা। বললেন, ‘আমার পেশাদার টেনিস ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল মেলবোর্নে। এর থেকে ভালো শেষ আর কী হতে পারে।’

দেশকে দেওয়ার মতো আরও কিছু ছিল হয়তো সানিয়ার! চোট, আঘাত, ইনজুরি তথা ভাগ্য সম্ভবত সেটি চায়নি! জড়িয়েছেন বিতর্কেও। যে নারীর ক্যারিয়ার কেশর উড়িয়ে বাধাহীন ঘোড়ার মতো উড়ে যাওয়ার কথা, তা যেন কিছুটা ফিকে ছিল। কিছুটা বিবর্ণও হয়েছে সানিয়া নাম!

তবে এটি বলা যথেষ্ট নয় যে, সানিয়ার র‍্যাকেট রঙ ছড়িয়েছে টেনিস কোর্টে। বরং বলা ভালো, দুঃসাহস, ভয়হীন, নির্ভীক সানিয়ার র‍্যাকেট হয়ে উঠত ঝাঁসির রানীর তলোয়ার। হারার আগে হারেননি কখনই। হারলেও ফেলেননি চোখের জল। এর আগে কেউ কি কখনও সানিয়ার চোখে জল দেখেছিলেন? উত্তর হবে, ‘না’।

সংবাদমাধ্যমের সামনে কখনও জড়তা, কখনও বা ঠোঁটকাটা ছিলেন। বর্ষীয়ান এক সাংবাদিককে মুখের ওপর কড়া কথা বলে তো ব্যাপক আলোড়নই ফেলে দিলেন।

সানিয়ার নাকের নোলক তো ভারতীয় টেনিসের স্টাইল স্টেটমেন্টই হয়ে উঠেছিল।

শুরুর দিনের উঠতি সুন্দরী তরুণী সানিয়া শেষ দিনে র‍্যাকেট চালাচ্ছিলেন ছেলে ইজহানের সামনে। স্ট্যান্ড থেকে মায়ের প্রতিটি পয়েন্টের জন্য উৎসাহ যোগাচ্ছিল ছেলে, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে?

সামনে হয়তো আবারও একটু-আধটু মাঠে নামবেন। র‍্যাকেট ধরবেন। অন্য টুর্নামেন্ট খেলবেন। কিন্তু সেগুলোর ধাঁচ, আঁচ নিশ্চয় গ্র্যান্ড স্লামের মতো নয়! তবুও সানিয়াকে কোর্টে দেখাই তো নীল জলের উত্তাল সমুদ্র। যার প্রতিটি ঢেউ যেন দোলা দিয়ে যায় প্রতিটি দর্শককে।

ক্যারিয়ারে কতজনের না হৃদয় জিতেছেন। মন ভালো করেছেন। উপহার দিয়েছেন স্মরণীয় দৃশ্য। ২০০৯ সালে এই মেলবোর্নের কোর্টেই মহেশ ভূপতিকে সঙ্গে নিয়ে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতেন। এর সাত বছর পর মেলবোর্নেই মার্টিনা হিঙ্গিসকে সঙ্গে নিয়ে নারীদের ডাবলস জিতেছিলেন সানিয়া। ভারতীয় টেনিসের জয়জয়কার দেখেছে উইম্বলডন, যুক্তরাষ্ট্র ওপেন, ফরাসি ওপেনও। যেন হাতে সূর্য ধরে এনে সানিয়া আলোর ছটা ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্ব জোড়া। আর সেটি আরও বেশি উজ্জ্বলতর হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়, তথা মেলবোর্নে।

সেখানেই তার শেষের কবিতা লেখা হলো। ইতি ঘটলো ভারতের টেনিস যুগের এক ইতিহাস। যার সমার্থক শব্দ হতে পারে একটুখানি দীর্ঘশ্বাসসহ, ‘সানিয়া মির্জা’।