আলি-আউলিয়ার বদৌলতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আধ্যাত্মিক ভূমি বলে পরিচিত সিলেট। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত সিলেটের কুমারগাঁও, যেখানে দিন-দুপুরে কয়েকজন তরতাজা যুবক সম্মিলিতভাবে মারতে মারতে মেরে ফেলেছে ১৩ বছরের এক সি্নগ্ধ কিশোরকে। মারতে মারতে মেরে ফেলার দৃশ্যটাকে মোবাইলে ভিডিও করে তারা ছড়িয়ে দিয়েছে ফেসবুকে। সি্নগ্ধ সে কিশোরের বিরুদ্ধে চুরি করার অভিযোগ। তাই তারা হয়তো বাংলাদেশকে জানিয়ে দিতে চাইল কত মহান কাজ তারা করে ফেলেছে অভিযুক্তকে পিটিয়ে মেরে ফেলে! ভিডিও দেখতে গিয়ে মানুষও বেশ নাড়া খেল। নড়ল বিবেক। কী দেখছে তারা এসব! ঘটনাটির ভিডিওচিত্র সবাই দেখছি বলে এত হাহাকার করছি, এই যা।
আহাজারিটা অন্য কোথাও হোক। ধরুন, ঘটনাটির ভিডিও তারা করেনি। করলেও সেটা তারা আপলোড করেনি। ধরুন, মারতে মারতে মেরে ফেলার পরে সি্নগ্ধ কিশোরটির লাশ তারা গুম করে ফেলতে সক্ষম হলো। আমরা জানতামই না এমন কিছু হয়েছে! হ্যাঁ, এমন ঘটনা অসংখ্য না হতে পারে, তবে প্রথম নয়। ওগুলো হয়। সবাই জানে না, কারণ মশগুল থাকার মতো বহু বড় বড় বিষয় মানুষের দৈনন্দিন তৈরি হচ্ছে। কিছু কিছু তৈরি করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে, কারণ দেশ শাসন বা আন্দোলনে সুবিধা দেয় বিভিন্ন ইস্যু। সে শিক্ষা মানুষ পেয়েছে শাহবাগে গণজাগরণের সময়। মানুষ চিৎকার করছে যুদ্ধাপরাধের শাস্তির দাবি নিয়ে, আর বিরোধীরা সমবেত হলো নাস্তিকতার উজবুকি অভিযোগ নিয়ে। যাই হোক, কোন সংস্কৃতিতে মানুষ দিন কাটাচ্ছে এখন? সমাজ ভেঙে পড়ার সংস্কৃতি। আইন ভেঙে পড়ার সংস্কৃতি। নৈতিকতা ভেঙে পড়ার সংস্কৃতি। সমাজ ভাঙছে, নৈতিকতা ভাঙছে প্রতিনিয়ত পৃথিবীজুড়েই। কিন্তু উন্নত বিশ্বে সমাজ ভাঙলেও রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়েছে। রাষ্ট্রই মানুষকে নৈতিক রাখছে আইনের কঠোর শাসনের মাধ্যমে। বিপরীতে বাংলাদেশের মতো দেশে সমাজ দুর্বল হচ্ছে, রাষ্ট্র শক্তিশালী হচ্ছে না।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ঘটা মৃত্যুর ঘটনাগুলোর দিকে একটু নজর রাখলেই বোঝা যায়, আমরা ধীরে ধীরে কোন আত্মঘাতী প্রবণতাকে বপন করে চলেছি। বিচারের আওতায় না এনে র‌্যাব-পুলিশ মানুষ মেরেছে। পুলিশদের পিটিয়ে মারা হয়েছে। তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা তাদের বিরোধীদের পিটিয়ে মেরেছে। হরতাল আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের নামে বাসে আগুন লাগিয়ে মানুষদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে। গুম হয়ে গেছেন বেশ ক'জন রাজনৈতিক নেতা। মাসখানেকের ব্যবধানে তিন-চারজন ব্লগ-লেখককে পাবলিক প্লেসে কুপিয়ে মারা হয়েছে। আর এসব ঘটনা নিয়ে সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ_ সবাই পক্ষ-বিপক্ষে বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে তর্কাতর্কি হয়েছে। বিচার না করে মানুষ মারার পক্ষে বৈধতার যুক্তি অনেকেই উপস্থাপন করেছেন।
সোস্যাল মিডিয়াকে একটা শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখেন অনেকেই। তাদের বেশিরভাগই সমাজবিচ্ছিন্ন, তবে সমাজ নিয়ে এক অদ্ভুত জাদুবাস্তবতায় মোহাবিষ্ট থাকেন সবসময় তারা।
কিশোরটির হত্যাকাণ্ড মানুষের চোখে পানি নিয়ে আসে। গালাগালিতে কোনো সমাধান আসবে না। এসব বর্বর ঘটনা থেকে যর্থার্থ বোধটা না নিতে পারলে বাংলাদেশের পতনের পথ আরও দীর্ঘ হবে। সি্নগ্ধ কিশোরটির হত্যাকারীদের বিচার হয়তো হয়েই যাবে। কারণ ওটা নিয়ে রাজনীতি করার তেমন কিছু নেই। কিন্তু যে অসহনশীল, অগণতান্ত্রিক ও মেরুকরণের সংস্কৃৃতি গড়ে তোলা হয়েছে তা সংশোধনের কোনো সহজ পথ খোলা নেই। কারণ, সে কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক চর্চার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মানুষের বোধোদয় হোক, আর নজরটা মূলে পডুক। সমস্যা না চিনতে পারলে সমাধানও আরেকটা সমস্যা।
শিক্ষক ( শিক্ষা ছুটি), সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, শাবিপ্রবি
হরশযরষ.ংড়প@মসধরষ.পড়স

মন্তব্য করুন