প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০১৮
মফিদুল হক
সন্জীদা খাতুন তো আমাদের সন্জীদা আপা, কখনো-বা মিনু আপা, কারও কারও মিনুদি। তাঁকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য এক বিরল পাওয়া, এর আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক কর্মমুখর দিকটি বিশাল, অন্যদিকে তাঁর অন্তরে রয়েছে গভীরতর আরেক মাত্রা, নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া, সতত আপন পথ তৈরি করে চলা। দুই পথ আলাদা নয়, দুইয়ের সম্মিলনে তিনি সন্জীদা খাতুন, নিজের যা কিছু অর্জন সব উজাড় করে দিতে চাইছেন সমাজের জন্য, সর্বজনের তরে।
হালে এর দুই প্রকাশ চাক্ষুষ করার সুযোগ আমার হয়েছিল, যা আজকের দিনে অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। ৯-১১ মার্চ নীলফামারীতে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সপ্তবিংশ বার্ষিক অধিবেশন। এমন এক সাংস্কৃতিক সংগঠনের দেশব্যাপী বিস্তারের পেছনেও রয়েছেন সন্জীদা খাতুন। আমরা এই সংগঠনের তল্পিবাহক, মুগ্ধ চোখে দেখি সম্মেলনের নানা আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, সমবেত বিশাল জনগোষ্ঠীর নজর থাকে মঞ্চের প্রতি, নিবেদিত হয় গীত-নৃত্য-বাদনের মনোহর কত না আয়োজন। এমনি সম্মেলনে তো বটেই, সম্মেলনের বাইরেও নানা সূত্রে সন্জীদা আপা যখন যান জেলা শহরে, ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলাদা করে বসেন গান শেখাতে, আমার কাছে সেটা মনে হয় অলৌকিক কোনো জাগরণী দৃশ্য। কথার তিনি ব্যাখ্যা দেন, সুরের ছোঁয়ায় বাণী কীভাবে নতুন দ্যোতনা পায় সেটা গেয়ে দেখান, তারপর কিশোর-কিশোরীদের কণ্ঠে তুলে দেন গান, কণ্ঠে সুর তোলা তো নয়, অন্তরে গেঁথে দেন গান, রবীন্দ্রনাথের সুবাদে। আমি সেসব তৃষিত আকুল শিক্ষার্থীদের মুখগুলো দেখি, উপমহাদেশের এক শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র-ব্যাখ্যাতা এবং একই সঙ্গে গুণী সঙ্গীতশিল্পী, তাঁর কাছ থেকে নবীনরা পাচ্ছে এমন এক প্রশিক্ষণ, যা সারা জীবনের অর্জন হয়ে রইবে। এই কাজের যে মহিমা এখন পেছন ফিরে তাকিয়ে তা আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করি। এর সঙ্গে মিলিয়ে নিই সাব-অলটার্ন বা নিম্নবর্গীয় ইতিহাস-ব্যাখ্যাতা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সঙ্গে আমার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎ ও তাঁর বক্তব্য। নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যতত্ত্বের এই অধ্যাপক এখন তত্ত্ব নয়, তত্ত্বের ভিত্তিতে কাজকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। তিনি মনে করেন, প্রান্তিক বা বঞ্চিত তথা নিম্নবর্গীয়দের নিয়ে কাজ করতে হবে অনেক বেশি এবং এই কাজ কোনো বৃহৎ কলেবরের পোশাকি ধাঁচের চেয়ে হতে হবে বিশেষভাবে ব্যক্তিপর্যায়ে, একের সঙ্গে অপরের, এক মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের। ঢাকায় এসেছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী এশিয়ান আর্ট সামিটে সমাপনী ভাষণ দিতে, সেখানে বক্তৃতায় যেমন এ কথা বলেছিলেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখে আলাপচারিতায় সেই প্রসঙ্গে তাঁর নিজের কাজও মেলে ধরেছিলেন, পুরুলিয়ার গ্রামে তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে কাজ করার অভিজ্ঞতা।
একের সঙ্গে অপরের সংযোগ, প্রত্যক্ষ কাজ; সঙ্গীত প্রশিক্ষণ তো সেই কাজই করে, করে আরও নিবিড়ভাবে এবং কতকাল ধরে ক্লান্তিহীনভাবে নিরন্তর সে দায়িত্ব স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে করে চলেছেন সন্জীদা খাতুন। সেই পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে তাঁর আজিমপুরের সরকারি আবাসের দ্বার সদা উন্মুক্ত থাকত নবীন-নবীনা শিক্ষার্থীদের জন্য। একই ধারা এখনও বহমান রয়েছে তাঁর ধানমণ্ডির অ্যাপার্টমেন্টে, সঙ্গীতের তালিম গ্রহণে আসেন নবীন শিক্ষার্থী, কোনো গানের সুর দেখিয়ে নিতে প্রবীণ শিল্পী, দলগত শিক্ষার্থীর সমাবেশ ঘটছে সেখানে, আজও তিনি ক্লান্তিহীনভাবে সবার কণ্ঠে তুলে দিচ্ছেন গান।
একই কাজ যখন তিনি করেন জেলা শহরে, মফস্বলে, সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক আয়োজনের অন্তরালে, বসেন একদল ছেলেমেয়ে নিয়ে গান শেখাতে, ঘুরেফিরে গেয়ে চলেন একই চরণ, প্রতিবারেই সুর পায় বিস্তার অর্থ অর্জন করে গভীরতা, তখন সুরের আগুনের উত্তাপ আমরা অনুভব করি, আর দূরপ্রান্তের শিক্ষার্থীদের মুখগুলো স্মরণে এনে বুঝি সাব-অলটার্ন কাজের তাৎপর্য, সঙ্গীত কীভাবে হয়ে উঠতে পারে সমাজের জিয়নকাঠি। সত্যিকারভাবেই তিনি সুরের আগুন ছড়িয়ে দিলেন সবখানে।
নীলফামারীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন সন্জীদা খাতুন, শারীরিক বাধা উপেক্ষা করে। উদ্যম আছে তার পুরোপুরি কিন্তু শক্তিতে কুলোয় না অনেক কিছু। মঞ্চে গান পরিবেশনে তিনি অপারগ, পুরো একটি গান একবারে গাইবার মতো দম পান না, প্রশিক্ষণ পরিচালনার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবু সন্জীদা খাতুনের উপস্থিতি, সভা ও সেমিনারে তাঁর সংক্ষিপ্ত তির্যক বক্তব্য প্রাণিত করে সবাইকে। এরই মধ্যে ঘটল অভাবিত এক ঘটনা, সম্মেলনে সারাদেশ থেকে আগত প্রতিনিধি শিল্পী দল প্রীতি-সম্মেলনে মিলিত হয়েছিল নীলসায়রে, শহর থেকে দূরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে। বিশাল দিঘির পাশে বৃক্ষ ছায়াতলের সেই সমাবেশে অনানুষ্ঠানিকভাবে চলছিল গান, আবৃত্তি, নৃত্য। সবার অনুরোধে এবং বোধ করি পরিবেশের আনুকূল্যে সন্জীদা আপাও রাজি হলেন গাইতে। হারমোনিয়াম-তবলা কিছু নেই, একেবারে খালি গলায় গান, তিনি গাইলেন, 'লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই?/ দেখ রে চেয়ে আপন পানে পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই।' গান যেন পাল্টে দিল তাঁর শারীরিক অসামর্থ্য, পুরো গানটিই তিনি গাইলেন বয়সের সব ছাপ পেরিয়ে। ভেসে ওঠে সেই পুরনো সজীব কণ্ঠ, তাঁর গায়কী, তাঁর সুর বিস্তারে প্রাপ্ত বাণীর অর্থময়তা, হালকা বাতাসে জেগে-ওঠা পাতার মর্মর, প্রকৃতির উদার আসন, সেই পরিবেশে সুর যেন হাহাকার করে ওঠে, পদ্মটি নেই, পদ্মটি নেই।
মনে হয় আমাদের আজকের বাস্তবতায় যেন গীত হচ্ছে এই গান, আমরা বিত্ত অর্জন করছি; কিন্তু চিত্তের সম্পদ হারিয়ে ফেলছি, মধ্য আয়ের দেশ হয়ে ওঠার বাদ্য সোচ্চার হচ্ছে; কিন্তু লক্ষ্মীমন্ত শ্রীময় জীবন নির্মাণের সাধনা নষ্ট হতে চলছে কতভাবে, নষ্ট করছি আমরা নিজেরাই।
সাম্প্রতিক দ্বিতীয় যে অভিজ্ঞতা সেটা তাঁর আবাসে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সূত্রে অর্জিত। আমি দেখি এখন, এই বয়সে, তিনি আবার গ্রহণ করছেন নজরুলের পাঠ এবং এর নানা তাৎপর্য নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করছেন, যা হয়ে উঠতে পারে ভিন্নতর নজরুল-বিচার। সেই সঙ্গে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি তাঁর অধ্যয়নের আরেক বিষয় হয়েছে জসীমউদ্দীন, বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী এবং কিছুটা বুঝি উপেক্ষিত মহান প্রতিভা। সন্জীদা খাতুন এভাবেই আবার নিজের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন, যার ফলভোগী হবো আমরা সবাই।
সন্জীদা খাতুন আমাদের ঘরে এসেছেন বটে, তবে যোগ্য আসনটি গড়ার কাজ আমরা করতে পারিনি। তিনি যেমন আমাদের প্রাণিত করেন, তেমনি দায়িত্ব সচেতনও করে তোলেন, তাঁর হাতে হাত রেখে বাঙালি জাতি প্রায় সাত দশকের পথ অতিক্রম করেছে। তিনি সেই পথচলার প্রেরণা ও সাথী, তাঁর জয় হোক।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব