সম্প্র্রতি আমাদের একটি গবেষণা নিবন্ধ- 'কম্বাইন্ড ইফেক্টস অব ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড সি-লেভেল রাইজ প্রজেক্ট ড্রামাটিক হ্যাবিটেট লস অব দ্য গ্লোবালি ইনডেঞ্জার্ড বেঙ্গল টাইগার ইন দ্য বাংলাদেশ সুন্দরবনস' বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী- 'সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট'-এ প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের গবেষণার ফলাফল দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকায় ফলাওভাবে প্রচারিত হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের গবেষণার ফল পরিবেশ বিশারদ ও প্রকৃতিপ্রেমীদের নতুনভাবে সুন্দরবনকে নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

বর্তমানে বিশ্বে টিকে থাকা বাঘের ছয়টি প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় বন্যপ্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার (বৈজ্ঞানিক নাম চধহঃযবৎধ :রমৎরংঃরমৎরং) বা সুন্দরবনের বাঘ শুধু বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারে পাওয়া যায়। প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরাজমান সুন্দরবন হচ্ছে এই বাঘের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক আবাসস্থল। এ ছাড়া সারাবিশ্বে সুন্দরবনের বাঘই একমাত্র প্রজাতি, যেটা অভিযোজনের মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

আমাদের গবেষণায় সুন্দরবনের জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের পাশাপাশি বাঘের বিচরণগত তথ্য, গাছ-গাছালি ও ভূমিবিন্যাস, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন স্থানের উচ্চতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানের উচ্চতার জন্য আমরা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার স্যাটেলাইট থেকে সংগৃহীত তথ্য ও জলবায়ুবিষয়ক তথ্যের জন্য আমরা ডঙজখউঈখওগ ডাটাবেজের তথ্য ব্যবহার করি এবং এসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) দুটি মূল সিনারিওকে (আরসিপি ৬.০ ওআরসিপি ৮.৫) বিবেচনায় নিয়ে কম্পিউটার সিমুলেশন ও মডেলিংয়ের সহায়তায় ২০৫০ ও ২০৭০ সালে সুন্দরবনে বাঘের সম্ভাব্য বিচরণক্ষেত্র নির্ণয় করি। এ ছাড়া আমাদের গবেষণায় সুন্দরবনের তিনটি প্রধান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যকে (ডরষফষরভব ঝধহপঃঁধৎু) বিবেচনায় নিই ও এই অভয়ারণ্যগুলোকে মূলত সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের জন্য সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং এগুলো থেকে যে কোনো ধরনের বনজসম্পদ আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

আমাদের গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৭০ সাল নাগাদ সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকা বাঘের বিচরণের অনুকূলে থাকবে না এবং জলবায়ুগত কারণ ছাড়াও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সুন্দরবনে বাঘের সহায়ক ও অনুকূল পরিবেশ কমে যাওয়ার মূল কারণ। আমাদের গবেষণায় আরও দেখা যায়, ভবিষ্যতে এ সুন্দরবনের বাঘ তুলনামূলক কিছুটা নিচু ও অধিক লবণাক্ত গরান অধ্যুষিত এলাকায় বিচরণ করবে। একটি বিষয় পরিস্কার করে দেওয়া উচিত, আমাদের গবেষণার ফলাফলও ভবিষ্যতে ঠিক এর কতটা ফলবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করবে আগামী দিনগুলোতে সুন্দরবনের অন্যান্য পরিবেশগত অবস্থা কতটা অপরিবর্তিত থাকবে তার ওপর। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের পাশাপাশি সুন্দরবন, জাতিসংঘের সহায়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ও জলাভূমি নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান রামসার ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি এলাকা। এ ছাড়া সুন্দরবনের বনজসম্পদের ওপর অনেক লোকের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। জলবায়ুগত পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি চোরা শিকারিদের দ্বারা অবৈধ বাঘ শিকার ও পাচার, ভারী স্থাপনা ও কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন সাইক্লোন ও মহামারী, খাদ্য সংকট, মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষ- এসব কারণেও সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে যেতে পারে। একইভাবে সুন্দরবন যেহেতু একটি সক্রিয় বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত; সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লেও মূল ভূখণ্ড থেকে আসা পলির কারণে এ বনের আয়তন আরও বিস্তৃত হতে পারে এবং কিছু এলাকা ভবিষ্যতে আরও উঁচু হতে পারে।

আমাদের গবেষণার ফল জলবায়ু পরিবর্তনকে যদিও সুন্দরবনের বাঘের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে, একই সঙ্গে এই গবেষণার কারণে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহল সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় আরও সচেতনতা ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। একই সঙ্গে সুন্দরবনে বাঘের জন্য সংরক্ষিত এলাকার আয়তন বৃদ্ধি, বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ বাঘ সংরক্ষণ কমিশন ও চোরা শিকারিদের কবল থেকে বাঘ রক্ষায়  যৌথ তদারকির কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায়  নেওয়া উচিত।

সহকারী অধ্যাপক, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিভাগ ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ; সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, সানশাইন কোস্ট ইউনিভার্সিটি

কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া

মন্তব্য করুন