- সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
- বিক্ষুব্ধ নগরীর গর্জন
সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
একাত্তরের এই দিনে
বিক্ষুব্ধ নগরীর গর্জন

ওই ইশতেহারে সশস্ত্র বাহিনীর সব বাঙালি সেনা, ইপিআর, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীকে জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণসহ শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহ্বান জানানো হয়। পল্টন ময়দানে উপস্থিত লাখ লাখ জনতা হাত তুলে এই ইশতেহার সমর্থন করেন। তখন 'তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব', 'শেখ মুজিবের পথ ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো' স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা পূর্ব পাকিস্তান।
হরতাল চলাকালে জনতার স্বতঃস্ম্ফূর্ত মিছিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এদিন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার বাইরেও। রংপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে বেলা আড়াইটা থেকে ২৪ ঘণ্টা কারফিউ জারি করা হয়। আর সিলেটে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকায় কারফিউয়ের মেয়াদ শিথিল করে রাত ১০টা থেকে সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বলবৎ করা হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন ঘোষণা দিয়ে ১০ মার্চ ঢাকায় নেতৃবৃন্দের সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তের কথা বলেন। রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণা করা হয়- এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি পাকিস্তান পিপলস পর্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর উদ্দেশে বলেন, গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান, তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বুলেটে আহতদের জীবন রক্ষার জন্য জনগণের প্রতি ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানের উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি জনসাধারণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাংলার স্বাধিকারবিরোধী বিশেষ মহল নিজস্ব এজেন্টদের দিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা ঘটাচ্ছে। স্বাধিকার আন্দোলনকে বিপথগামী করার এ অশুভ চক্রান্ত রুখতেই হবে।
৩ মার্চ বিভিন্ন স্থানে মিছিলে গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনায় প্রায় একশ জন নিহত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অনুপস্থিতিতে আন্দোলন চালানোর রূপরেখা দিয়ে বলেন, 'হয়তো ইহাই আপনাদের সামনে আমার শেষ ভাষণ। আগামী রবিবার (৭ মার্চ) রেসকোর্সে আমার বক্তৃতা করার কথা। কিন্তু কে জানে, সে সুযোগ আমাকে নাও দেওয়া হইতে পারে। তাই আজ আপনাদের কাছে আর আপনাদের মাধ্যমে বাংলার জনগণের কাছে আমি বলিয়া যাইতেছি, আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন না থামে।' তিনি আরও বলেন, 'বাংলার ভাইয়েরা আমার, আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন না থামে, বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি যদি নাও থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তারাই নেতৃত্ব দিবেন।
আর যদি কেউই না থাকে, তবু আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে- যে কোনো মূল্যে বাংলার স্বাধিকার ছিনাইয়া আনিতে হইবে।'
গ্রন্থনা :মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন