- সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
- জনকল্যাণই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান
সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
স্মরণ
জনকল্যাণই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান
মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন |
মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২১ । ০০:০০
আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২১ । ০১:৩৫
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২১ । ০০:০০ । আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২১ । ০১:৩৫
মোহাম্মদ হানিফ (১৯৪৪-২০০৬)
ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহচর্য থেকে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় মোহাম্মদ হানিফের। আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। ১৯৬৫ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে অত্যন্ত সফলতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকার রাজনীতির এই ত্যাগী মানুষটি ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
স্বাধীনতাপরবর্তী সব আন্দোলন-সংগ্রামেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোহাম্মদ হানিফ। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা-১২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে হুইপের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুসহ তার পুরো পরিবারকে হত্যা করে ঘাতকরা। মেয়র হানিফ এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে দৃপ্ত শপথে বলীয়ান ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।
জনকল্যাণ ছিল মেয়র হানিফের ধ্যানজ্ঞান। জাতির প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মানসিকতার কারণে তিনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে অসামান্য গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন। একজন জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তিনি ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি বিপুল ভোটে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তার আমলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে রোড ডিভাইডার, পদচারী সেতু, আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় ধানমন্ডি লেক ও আশপাশ এলাকাকে। ঢাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও নাগরিক চাহিদা মেটাতে নগরীতে বিজলি বাতি স্থাপন, ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন এবং সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি। নারী শিক্ষার প্রসারে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ। নারীদের মাতৃত্বকালীন পরিচর্যার জন্য নগরীতে বেশ কয়েকটি মাতৃসদন নির্মাণ করেন। এ ছাড়া শিশু পার্ক নির্মাণ, মশা নিধনে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, ক্রীড়াচর্চাসহ নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে নানাবিধ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছেন মেয়র হানিফ, যা আজও দৃশ্যমান।
মোহাম্মদ হানিফ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রতি বিশ্বস্ততার বড় প্রমাণ দিয়েছেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ওই দিন সে সময়কার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল ঘাতকরা। সেদিন যারা মানবদেয়াল তৈরি করে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সুরক্ষা দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। গ্রেনেড হামলায় হানিফ ভাই মারাত্মকভাবে আহত হন। তার মস্তিস্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকটি স্পিল্গন্টার প্রবেশ করেছিল। ঢাকায় অপারেশন করে তার মাথা থেকে স্পিল্গন্টারগুলো বের করা যায়নি। খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা নিয়েও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে তাকে যেদিন দেশে আনা হয়, সেদিন বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম তাকে আমাদের মাঝে নিয়ে আসতে। হানিফ ভাই সেদিন শুধু তাকিয়ে ছিলেন; কোনো কথা বলতে পারেননি।
২০০৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় মোহাম্মদ হানিফ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থেকে ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। অনেক দিন হলো, তিনি গত হয়েছেন। তিনি আমাদের মাঝে থাকলে হয়তো ঢাকা শহর আরও এগিয়ে যেত; আরও এগিয়ে যেত বাংলাদেশ। একজন সফল রাজনীতিক ও জননেতা হিসেবে আমাদের মাঝে চিরদিন বেঁচে থাকবেন তিনি। মৃত্যু দিবসে তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ এবং তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। তরুণ প্রজন্ম মেয়র মোহাম্মদ হানিফের নেতৃত্ব, সততা, বিশ্বস্ততা ও ত্যাগে বলীয়ান হয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত করবে- সেটাই প্রত্যাশা।
সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ); সদস্য, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
মন্তব্য করুন