নারী মানব সমাজের মানবীয় জীবনপ্রণালির সঙ্গী। বিশ্বসভ্যতায় নারীর অবদান ঐতিহাসিক কাল থেকেই স্মরণীয়-বরণীয়। সময়ের পরিক্রমায় সমাজ পরিবর্তনের ধারায় বিবর্তন, উন্নতি, প্রগতি সাধিত হয়েছে। মানুষ বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন যৌক্তিক প্রাণী। মান ও হুঁশ দুটো যোগ্যতার অধিকারী মানুষই মর্যাদায় সমাসীন। কিন্তু শ্রদ্ধাবোধের সংকট, অসততা ঘুণে ধরা সমাজকে নিয়ত ভারসাম্যহীন করে অপসংস্কৃতির চর্চা বৃদ্ধি করে। তাতে সমাজ কাঠামোকে বিশ্নেষণ করা তথা সমাজকে নতুনভাবে দেখার প্রয়াস পায়।

দেশ এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। উন্নয়নের মহাসড়কে নারীর নানা ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, অবদান, সাফল্য প্রশংসার দাবিদার। উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় গঠিত নারীর অংশীদারিত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু জীবন-জীবিকার অনিবার্যতায় ব্যক্তি, সমাজের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত। মানবতা, মানবপ্রেম ভূলুণ্ঠিত। মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ। গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অবক্ষয়ে ভারাক্রান্ত সমাজ ভারসাম্যহীন হচ্ছে। তাতে মানব উন্নয়ন সূচক নিম্নগামিতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। গণপরিবহনে নারীর ওপর নির্যাতন তথা নিরাপত্তাহীনতা, মর্যাদাহানির বিষয়গুলো সামাজিক অবক্ষয়েরই নামান্তর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে শুধু ভোগের বস্তু মনে করা হয়। এতে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এর সঙ্গে অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে কোমলমতি শিশুরাও। খুব যৌক্তিকভাবে মা ও শিশুর সম্পর্ক প্রকৃতিগত। একজন মা, একজন নারী যখন নির্যাতনের শিকার হন প্রকান্তরে শিশুটির ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গণপরিবহনে নারীরা নানা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। নারী-শিশু, প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত সিটে পুরুষরা নির্বিকার বসে থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই তাদের চলাচল করতে হয়।

গণপরিবহনে নারীর বিপদসংকুলতার চিত্র আমরা দেখতে পাই। চট্টগ্রামে কাজ শেষে গৃহে ফেরার পথে বাসের অন্য যাত্রীদের নামিয়ে শুধু একজন নারী পোশাক কর্মীকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। ঢাকার সন্নিকটে ধামরাইয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় এক পোশাক কর্মী। সাভারগামী যাত্রীসেবা পরিবহনের একটি বাসে ঘটে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা। টহল পুলিশের দ্রুত তৎপরতায় ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। ঢাকায় গারো তরুণীকে মাইক্রোবাসে ধর্ষণ করা হয়। সাভারের আশুলিয়ায় রাত্রিবেলায় মিনিবাসে ছয় দুর্বৃত্ত পালাক্রমে ধর্ষণ করে এক তরুণীকে। এমন দৃষ্টান্ত আরও দেওয়া যাবে এবং কোনোটিই দূর অতীতের নয়। এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত গণপরিবহনে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ৩৫টি। লোমহর্ষক, অনভিপ্রেত ঘটনার মধ্যে ১৩ শতাংশ নারীকে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালে গণপরিবহনে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ জন নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যাত্রী কল্যাণ সমিতি প্রকাশিত প্রতিবেদনের হিসাব অনুসারে সড়কপথে ৪৪টি, রেলপথে ৪টি, নৌপথে ৪টি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৬টি ধর্ষণ, ১২টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ৩৯টি ধর্ষণচেষ্টা ও ১৫টি যৌন হয়রানি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ মহিলা যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার।

পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহনগুলোর দুর্বলতা, নৈতিক শিক্ষা অর্জন ও চর্চার অভাব, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব, ভুক্তভোগীদের প্রতিবাদের প্রতি ভয়, অনীহা, ধর্ষিতার লোকলজ্জার ভয়, অপরাধীর ক্ষমতার দাপট, বিচার প্রক্রিয়ায় ধীরগতি কিংবা বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ পুনর্গঠন না হওয়ার বিরূপ ফল হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুমুখী। সংবিধানে নারী-পুরুষ বৈষম্য নেই। সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার ও সুযোগ ভোগে বাধা নেই। তাই নারীর ক্ষমতায়ন অর্জনে রাষ্ট্রকে সব ধরনের ব্যবস্থা করতে হবে। নারীর জন্য পৃথক পরিবহন ব্যবস্থা রাখতে হবে। গণপরিবহনে সংরক্ষিত নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখতে হবে। অপরাধের স্থান চিহ্নিত করে দ্রুত নির্যাতিত-নিপীড়িত নারীকে রক্ষার্থে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। হাইওয়ে পুলিশ ও টহল পুলিশি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সংশ্নিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যুগোপযোগী ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হতে হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে নৈতিক দায়িত্বশীলতার জায়গাটি সুস্পষ্ট করতে হবে। চালক-হেলপারদের মানসিক সুস্থতার জন্য সুস্থ বিনোদন, কাউন্সেলিং, উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিআরটিসি, বিআইডব্লিউটিসিসহ সংশ্নিষ্ট দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারীরা আমাদের মা, বোন, কন্যা। তারা সম্মানের দাবিদার, অতি আপনজন।

মোশারফ হোসেন: প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
mamun86cu@gmail.com

মন্তব্য করুন