প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১
সমকাল প্রতিবেদক
সংসদ সচিবালয় থেকে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কুয়েতের আদালতে নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ায় বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী পাপুল আর সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য নন।
অর্থ ও মানব পাচার এবং ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে গত বছর জুনে কুয়েতে গ্রেপ্তার হন পাপুল। ব্যবসার সূত্রে সেখানে তার বসবাসের অনুমতি ছিল। ওই মামলার বিচার শেষে গত ২৮ জানুয়ারি তাকে কারাদণ্ড দেন কুয়েতের একটি আদালত। নির্বাচন কমিশন সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় জানান, আসন শূন্য ঘোষণা-সংক্রান্ত গেজেটের কপি হাতে পেয়েছেন। পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কমিশনের কাছে উপস্থাপন করা হবে।
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম জানান, সাংবিধানিকভাবে পাপুলের আসন শূন্য ঘোষণার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সেখানে নির্বাচনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, সংসদ সচিবালয়ের চিঠি কমিশন সভায় উপস্থাপনের পর সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানে ৪০-৪৫ দিন সময় লাগবে। ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। এর পরই তফসিল ঘোষণা করা হবে।
সংবিধানের ৬৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে কোনো এমপির দুই বছরের বেশি জেল হলে পদ বাতিল হবে। পরবর্তী পাঁচ বছর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে কেউ বিদেশের আদালতে দণ্ডিত হলে কী হবে, তা বলা নেই। তাই পাপুলের রায় ঘোষণার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে বিশ্নেষকরা নানা মন্তব্য করছিলেন। কেউ বলছেন, সংবিধানে বিদেশের আদালতের বিষয়ে কিছু বলা নেই, তাই আইনি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আবার কেউ বলেছেন, দেশে-বিদেশে যেখানেই সাজা হোক, এমপি পদ থাকবে না।
সংসদ সচিবালয়ের সংশ্নিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা আগেই জানিয়েছিলেন, সংবিধানের ৬৬(খ) অনুচ্ছেদে দুই বছরের বেশি সাজা হলে এমপি পদ বাতিলের বিধান থাকলেও সংবিধানে সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের যে সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাতে বিদেশের আদালত অন্তর্ভুক্ত নয়। আবার দণ্ডবিধির ৩ ধারা অনুযায়ী কোনো বাংলাদেশি বিদেশে অপরাধ করলেও দেশে তার বিচারের সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইনের বিধান এমনভাবে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে, যেন অপরাধ বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে। এ ধারার কারণে পাপুলের পদ থাকার কথা নয়।
মানব পাচারের শিকার পাঁচ বাংলাদেশির অভিযোগে পাপুলকে ঘুষ দেওয়ার দায়ে ৫৩ কোটি টাকা জরিমানা করেছেন কুয়েতের আদালত। তবে মানব পাচার ও অর্থ পাচারের মামলাগুলো এখনও নিষ্পত্তি না হওয়ায় তার সাজা আরও বাড়তে পারে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েত গিয়ে বিশাল ব্যবসা গড়ে তোলেন পাপুল। তার মালিকানাধীন মারাফি কুয়েতিয়া কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেওয়ার কাজ শুরু করে। সেখানে পাপুলের অন্যান্য ব্যবসাও রয়েছে।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পাপুলের আবির্ভাব ঘটে ২০১৬ সালের শেষ দিকে। তিনি কুয়েত শাখা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন। একাদশ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েও পাননি। পরে 'আপেল' প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।
ওই নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মনোনয়ন পেয়েছিলেন জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ নোমান। কিন্তু ভোটের দিন দশেক আগে তিনি পাপুলকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আলোচনা রয়েছে, ১২ কোটি টাকার বিনিময়ে মহাজোটের প্রার্থীকে বসিয়ে দিয়েছিলেন পাপুল। পরে টাকার জোরে স্ত্রী সেলিমা ইসলামকেও স্বতন্ত্র এমপিদের কোটায় সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি বানিয়ে আনেন বলে আলোচনা রয়েছে।
২০১৯ সালেও তার বিরুদ্ধে মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগ এসেছিল কুয়েতের গণমাধ্যমে। এমপি হিসেবে পাপুল কূটনৈতিক লাল পাসপোর্টধারী হলেও গত বছর তিনি কুয়েত গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত পাসপোর্টে।
কুয়েতে গ্রেপ্তারের পর দেশেও পাপুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। তিনি ও তার স্ত্রীর নামে ৬১৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পাওয়া যায়। তার পরিবারের সদস্যদের ৬৭০টি অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। এর মধ্যে ৫৩টি অ্যাকাউন্টে ৩৫৪ কোটি টাকা পাওয়া যায়। পাপুলের নির্বাচনী হলফনামায় এর অধিকাংশেরই উল্লেখ ছিল না। বিশ্নেষকদের অনেকেই মনে করেন, নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী শুধু এসব তথ্য গোপনের কারণেই পাপুলের এমপি পদ বাতিল এবং তার সাজা হওয়া উচিত ছিল।
সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেন স্থানীয়রা :লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, আসন শূন্য ঘোষণার পর রায়পুর উপজেলার নতুন বাজার এলাকায় মিষ্টি বিতরণ ও আনন্দ মিছিল করা হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান মুন্সি রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, কালো টাকার ব্যবহার, অপরাজনীতি, রাজনীনিতে দুর্বৃত্তায়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ অর্থের ব্যবহার করে ক্ষমতায় এলে তা চিরস্থায়ী হয় না। ভবিষ্যতে রাজনীতিতে এ ধরনের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।
জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট হাছিবুর রহমান বলেন, অবৈধ অর্থ ব্যবহারের ফলে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েছে। দেশে ও বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন চলছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।