বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দলের জন্ম দেয়, সেই দলের নেতারা ঐতিহাসিক ওই ভাষণের ভাষা ও মর্ম বুঝবে না- এটাই তো স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে গতকাল সোমবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, 'এরা (বিএনপি) এখনও তাদের পুরোনো প্রভুদের (পাকিস্তান) ভুলতে পারেনি। পাকিস্তানের দালালি ও চাটুকারিতার কথাও ভোলেনি। তারা তাদের (পাকিস্তান) পালিত সারমেয় দল হিসেবেই এখনও আছে।

তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ছিল জিয়াউর রহমান।

সে ওই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল। পাকিস্তানি অফিসার জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারাদেশের মতো চট্টগ্রামের রাস্তায় যেসব বাঙালি ২৫ মার্চ রাতে ব্যারিকেড দিচ্ছিলেন, তাদের ওপরে যারা গুলি চালিয়েছিল; তাদের একজন জিয়াউর রহমান। সে আগাগোড়াই পাকিস্তানের দালালি করেছে। তার জন্ম ও লেখাপড়া পাকিস্তানে। চাকরিসূত্রে এখানে এসেছিল। পরে বিয়ে করে থেকে যায়। এসব তো বাস্তবতা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, যারা ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, যারা দেশটাকে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ক্ষমতা নিয়ে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, তাদের তৈরি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ কী আশা করতে পারে?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সভায় সূচনা বক্তৃতা করেন। আরও বক্তৃতা করেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, শ্রম সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কার্যনির্বাহী সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মেরিনা জাহান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী এবং উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। গণভবন প্রান্ত থেকে সভা পরিচালনা করেন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। সভায় মুজিব শতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও ৭ মার্চের ভাষণের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ 'মুক্তির ডাক'-এর মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।

ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি অর্জনে বাঙালির আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা পায়নি। বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই জানতেন, নির্বাচনে জিতলেও পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতা দেবে না। লড়াই করেই স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। তিনি সে জন্য সব প্রস্তুতি আগে থেকেই করেছিলেন।

৭ মার্চের ভাষণই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি অক্ষরই ছিল একেকটি নির্দেশনা। বাঙালির ওপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা-বঞ্চনার ইতিহাস বর্ণনার পাশাপাশি ভবিষ্যতে কী করণীয়- বঙ্গবন্ধু তারও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি সর্বাত্মক গেরিলা যুদ্ধের জন্য ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' বলার মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার যে নির্দেশনা ৭ মার্চের ভাষণে দিয়ে গেছেন, সেই নির্দেশ বাঙালি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দেশ স্বাধীন করেছে।

শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর মূল শক্তি ছিল জনগণ। সেই শক্তি নিয়েই তিনি ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণই মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে। যারা বাঙালির এই বিজয় মেনে নিতে পারেনি, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন চায়নি, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ যারা মানতে পারেনি, তারাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট চরম আঘাত হানে। অথচ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে স্বাধীনতার পর ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশের সেই অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসই মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শত বাধা-নির্যাতন উপেক্ষা করেই সেই ভাষণ বাজিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আবেদন এখনও কমেনি। অথচ একটি শ্রেণি এই ভাষণের মধ্যে কিছুই খুঁজে পায় না। কিছুই বোঝে না। ওই নির্বোধরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্যে কিছু খুঁজে না পেলেও আন্তর্জাতিকভাবে ভাষণটি নিজের জায়গা করে নিয়েছে। ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ঘোষণা করে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ৭ মার্চের ভাষণের পর বিশ্বখ্যাত নিউজউইকে বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

শেখ হাসিনা বলেন, ৭ মার্চের ভাষণের নির্দেশনা মুক্তিপাগল বাঙালি বুঝতে পারলেও পাকিস্তানি হানাদারদের দালাল, চাটুকার ও তোষামোদকারী দলের নেতারা কিছু বোঝে না। তিনি ৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, পাকিস্তানি শাসকরা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিল। তারা বোমা মেরে সমাবেশে উপস্থিত সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু ভাষণে কী বললেন কিংবা কী নির্দেশনা দিলেন, তা বাঙালিরা বুঝতে পেরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেও শত্রুপক্ষের বুঝতে দেরি হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জাতির পিতা শুধু রাজনীতিবিদই ছিলেন না, একজন দক্ষ রণকৌশলীও ছিলেন। পাকিস্তানিরা যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণ করতে পারে, এ জন্য তিনি সব রকম প্রস্তুতিসহ সব নির্দেশনা আওয়ামী লীগের নেতাদের দিয়ে গিয়েছিলেন। কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, কোথা থেকে অস্ত্র আসবে, কীভাবে ট্রেনিং হবে- সব ব্যবস্থাই তিনি করে গেছেন। বাঙালির সংগ্রাম যেন কোনোভাবেই ব্যর্থ না হয়, স্বাধীনতা যেন অর্জিত হয়- সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর একমাত্র লক্ষ্য। সে জন্য নিজের জীবনে যত ঝুঁকিই আসুক, বঙ্গবন্ধু তা নিয়েছিলেন।

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পিলখানার ইপিআরের মাধ্যমে সমগ্র দেশে প্রচার করা হয়। রেডিও, টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীন বাংলা, অর্থাৎ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকেও ঘোষণাটি প্রচার করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতারা একের পর এক সেই ঘোষণা প্রচার করতে থাকে।

প্রধানমন্ত্রী জানান, সে সময় আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী সেনাবাহিনীর একজনকে আনার কথা বলেছিলেন। চট্টগ্রামে ওই সময় মেজর রফিকুল ইসলাম অ্যামবুশ অবস্থায় ছিলেন। তাকে প্রথমে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি রেডিওতে পাঠ করার কথা বলা হয়। তখন তিনি জানান, তিনি অ্যামবুশ অবস্থায় রয়েছেন। তিনি সরে গেলে পাকিস্তানিরা তার জায়গাটা দখল করে নেবে। তখন জিয়াউর রহমানকে ধরে নিয়ে এসে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করতে বলা হয়। এ জন্যই জিয়াকে তারা (বিএনপি) ঘোষক বলে প্রচার করে। তিনি বলেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, সবাইকেই সম্মান দেওয়া হয়েছে। জিয়াকে মেজর থেকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ যাচ্ছিল সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে। সে যাতে অস্ত্র নামাতে না পারে, সে জন্য সংগ্রাম পরিষদের নেতারা তাকে বাধা দিয়েছিলেন। সাধারণ জনগণই জিয়াউর রহমানকে আটকে দিয়েছিল। সুতরাং গণহত্যা শুরুর পরও জাহাজ থেকে যে অস্ত্র নামাতে যায়, জাতির পিতাকে হত্যার পর সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে; দল গঠন করেছে, সেই দলের নেতারা ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা ও মর্ম বুঝবে না- এটা তো খুবই স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার মাত্র ১২ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করেছে। এটা বোধ হয় তাদের (বিএনপি) একটুও পছন্দ না। কারণ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সফল হোক, মানুষ পেট ভরে ভাত খাক, সুন্দর ও উন্নত জীবন পাক- এটা তো তাদের পছন্দ না। কারণ তাদের (বিএনপি) কাছে ক্ষমতা ছিল ভোগের বস্তু। তারা হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছে। তারা মানুষের দুঃখ-কষ্ট বুঝবে কীভাবে? তাই তো ইতিহাসকে তারা বিকৃত করেছে নিজেদের স্বার্থে।

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, 'ওরা (বিএনপি) কী বলল- এটা নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। চিন্তা করারও কিছু নেই। আমরা জনগণের পাশে আছি। আমরা জনগণের জন্য কাজ করি। করোনাভাইরাসের সময় কত কথাই তো তারা (বিএনপি) বলেছে। টিকা নিয়েও তো কত কটূক্তি! কিন্তু সেই টিকা তাদের নিতে হলো। আমি সরকারে আছি। পয়সা দিয়ে টিকা এনে বিনা পয়সায় দিচ্ছি। সেই বিনা পয়সায় টিকা তো তারা নিয়েছে। কিন্তু তার আগে বিএনপি নেতাদের কথাগুলো কী ছিল? তাই ওরা অনেক কথাই বলবে। কিন্তু তাদের কথা নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট না করাই ভালো।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরাও জনগণের পাশে আছি। জনগণের কল্যাণ করাই আমাদের লক্ষ্য। মুজিব শতবর্ষে আমাদের সিদ্ধান্ত স্পষ্ট- বাংলাদেশের একটি মানুষও ভূমিহীন এবং গৃহহীন থাকবে না। প্রতিটি মানুষের জন্য একটা ঠিকানা আমরা করে দেব। সেই পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি এবং সেটা বাস্তবায়ন করছি। ইনশাআল্লাহ, আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলবই।'

মন্তব্য করুন