বারবার রূপ বদলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া করোনার ওমিক্রন ধরনের সংক্রমণের ক্ষমতা এতটাই বেশি যে, করোনাজয়ীরাও তাতে আক্রান্ত হতে পারেন। এই ঝুঁকি খুবই বেশি। সামগ্রিকভাবে ওমিক্রনের প্রভাব হতে পারে ভয়াবহ। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি ও করণীয় নির্ধারণে আয়োজিত জরুরি অধিবেশনে এসব সতর্কতা উচ্চারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। একই সঙ্গে করোনা ঠেকাতে টিকা-বৈষম্য দূর করে সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

সংস্থাটির আহ্বানে ১৯৩টি সদস্য দেশের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ (ডব্লিউএইচএ) জেনেভায় এই অধিবেশনে বসেছে। সংস্থাটির গত ৭৩ বছরের ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় জরুরি অধিবেশন।

এমন সময় ডব্লিউএইচএ এই অধিবেশনে বসল, যখন আফ্রিকার বতসোয়ানা থেকে এরই মধ্যে ১৩টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ওমিক্রন। তবে এখনও কোনো মৃত্যু রেকর্ড করা হয়নি। রোববার দক্ষিণ কোরিয়ার একজন ভাইরোলজিস্ট জানান, ওমিক্রনে আক্রান্তদের উপসর্গ মৃদু। তবে কিছু উপসর্গ অপরিচিত, অর্থাৎ নতুন রূপে প্রকাশ পাচ্ছে।

এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আট দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে অধিকাংশ দেশ। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এরই মধ্যে ওমিক্রন নিয়ে নিজেদের জারি করা ১২টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে রেখেছে ভারত। যদিও বাংলাদেশে এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত কেউ শনাক্ত হয়নি। জরুরি অধিবেশনে বসার আগে ওমিক্রন সম্পর্কে ডব্লিউএইচও দুই ধরনের মন্তব্য করেছে। গত রোববার এক বিবৃতিতে এই ধরনকে 'উদ্বেগজনক' আখ্যা দিয়ে তাড়াহুড়া করে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি না করে বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেয়। তবে গতকাল এক সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে সংস্থাটি বলেছে, ওমিক্রন বিশ্বকে অত্যন্ত ঝুঁকিতে রেখেছে।

এরপর জেনেভায় জরুরি অধিবেশনে সংস্থাটির প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস একই সতর্কতা উচ্চারণ করে ওমিক্রন মোকাবিলায় সব দেশকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ওমিক্রনের বিস্তার রোধ করা ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলায় আমাদের যৌথ সামর্থ্যের একটি পরীক্ষা।

১৯৮টি দেশের এই অধিবেশনে আলোচনায় রয়েছে 'মহামারি চুক্তি' বা 'আইনসিদ্ধ বাধ্যবাধকতার নির্দেশিকা'র খসড়া। এটি সব দেশ অনুমোদন করলে তা হবে বর্তমান মহামারিসহ ভবিষ্যতের মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার সর্বোত্তম পথ।

ওমিক্রন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফুসি বলেছেন, করোনার ডেলটা ধরনের চেয়েও বেশি সংক্রামক হতে পারে ওমিক্রন। তবে আগামী দুই সপ্তাহের আগে এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উপদেষ্টা ও বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বলেছেন, ওমিক্রন নিয়ে সতর্ক হতে হবে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

ওমিক্রনের বিরুদ্ধে করোনার প্রচলিত টিকা কার্যকর কিনা, তা জানতেও অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ। টিকা উৎপাদনকারী কোম্পানি মডার্না, ফাইজার ও জনসন অ্যান্ড জনসন রোববার এ বিষয়ে বিবৃতিতে দিয়েছে।

গত ৯ নভেম্বর বতসোয়ানায় প্রথম ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ নভেম্বর দেশটি নতুন এই ধরন সম্পর্কে বিশ্বকে জানায়। জোহানেসবার্গ নিয়ে গঠিত দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রদেশে পিসিআর পরীক্ষায় গত কয়েক দিনে মোট করোনা শনাক্ত এক হাজার ১০০ রোগীর মধ্যে ৯০ শতাংশ ওমিক্রনে আক্রান্ত। আশা করা হচ্ছে, ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় দিনে ১০ হাজার রোগী শনাক্ত হতে পারে।

১৩ দেশে ওমিক্রন শনাক্ত :সোমবার পর্যন্ত ১৩টি দেশে ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বতসোয়ানায় ১৯ জন, যুক্তরাজ্যে তিনজন, জার্মানিতে দু'জন, নেদারল্যান্ডসে ১৩, ডেনমার্কে দু'জন, বেলজিয়ামে একজন, ইসরায়েলে একজন, ইতালিতে একজন, চেক প্রজাতন্ত্রে একজন, হংকংয়ে দু'জন, অস্ট্রেলিয়ায় দু'জন ও কানাডায় দু'জন আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তের মধ্যে প্রায় সবাই সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা অথবা আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলো ভ্রমণ করেছেন।

দেশে দেশে বিধিনিষেধ :ওমিক্রন ধরনের কারণে আফ্রিকার আট দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কমপক্ষে ৪৪টি দেশ। সর্বশেষ গতকাল জাপান নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। একই সঙ্গে ওমিক্রনের ঝুঁকি এড়াতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগে বিধিনিষেধ কড়াকড়ি করেছে। ইসরায়েল সব দেশের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

সংক্রমণ ঠেকাতে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ সাতটি দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশ। অস্ট্রেলিয়ার সীমান্ত খোলা কথা থাকলেও তারা তা স্থগিত করেছে। নিউজিল্যান্ড জানিয়েছে, ওমিক্রন ঠেকাতে প্রস্তুত তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নও নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি পর্যালোচনা করছে।

জি৭-এর জরুরি বৈঠক :উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাজ্যের আহ্বানে গতকাল জরুরি বৈঠক করার কথা উন্নত দেশগুলোর সংগঠন জি৭-এর। অর্থনীতিতে যেন বড় ধাক্কা না লাগে, সে বিষয়ে আলোচনা করার কথা তাদের।

ভারতের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় বাংলাদেশ :ওমিক্রন সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে ভারত। এখন ভারতে যাওয়া বাংলাদেশি ও অন্যদের বিমানবন্দরে করোনার আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। রোববার থেকেই এটি কার্যকর হয়েছে।

ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশগুলো হলো- যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, বতসোয়ানা, চীন, মরিশাস, নিউজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, সিঙ্গাপুর, হংকং ও ইসরায়েল। সূত্র :আলজাজিরা, বিবিসি, এএফপি, এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও সিএনএন।





মন্তব্য করুন