ড. মো. শাহজাহান কবীর |
ড. মো. শাহজাহান কবীর
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ । আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ইসলাম এমন একটি জীবন বিধান, যেটি সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়। পবিত্র কোরআনের সুরা রুমে ২২ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন- আর তাঁর নির্দেশনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।
এখান থেকে স্পষ্ট হয়, ইসলাম প্রতিটি জাতির ভাষার মর্যাদাকে স্বীকার করে। আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তাদের ভাষা দান করেছেন। আল্লাহর দরবারে বান্দা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণে যে প্রার্থনা করবে, তা হওয়া উচিত তার মাতৃভাষায়। কারণ মাতৃভাষায় মানুষ যে আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করে, তা অন্য কোনো ভাষায় সম্ভব নয়। তাই মহান আল্লাহ প্রত্যেক নবী-রাসুলকে নিজ নিজ উম্মতের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন, যাতে তারা নিজ নিজ উম্মতকে দ্বীন ইসলামের দাওয়াত স্পষ্টভাবে পৌঁছাতে পারেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কোরআনুল কারিমের সুরা ইবরাহিমের ৪ আয়াতে ইরশাদ করেন, আমি প্রত্যেক রাসুলকে তাঁর নিজ জাতির ভাষায় পাঠিয়েছি, যাতে তাদের আল্লাহর বিধান সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন। আল্লাহতায়ালা মহানবী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) উদ্দেশ করে সুরা দুখানের ৫৮ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, আমি তো কোরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে নাজিল করেছি, যাতে তারা সহজে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।
সুরা আশ শুরার ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন- এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল করেছি, যাতে আপনি মক্কা ও তার আশপাশের লোকদের হাশরের দিন সম্পর্কে সতর্ক করেন। ভাষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সুরা ইউসুফের ২ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, আমি কোরআনকে আরবি ভাষায় নাজিল করেছি, যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পারো।
সুরা মারিয়ামের ৯৭ নম্বর আয়াতে রাসুলে পাককে (সা.) লক্ষ্য করে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন-
আমি কোরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি অতি সহজে মুত্তাকিদের সুসংবাদ দেন আর কলহকারীদের সতর্ক করেন। আল কোরআনের এসব আয়াত দ্বারা আমরা জানতে পারি ইসলামী আদর্শ যেমন সর্বজনীন, তেমনি ভাষা, বর্ণও সর্বজনীন। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই; অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তাঁর কথা থেকেও স্পষ্ট হয়, কোনো ভাষাকে হেয় করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অবহেলা করা যাবে না। কেননা, ভাষার স্রষ্টাও মহান আল্লাহ।
তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের ভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। মরিয়া হয়ে উঠেছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। তাদের এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে বাংলাভাষীরা গড়ে তোলেন তীব্র আন্দোলন। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগানে মুখর করে তোলেন রাজপথ। এ দুর্বার আন্দোলনে শামিল হয়ে মায়ের ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত উৎসর্গ করেন এদেশের ছাত্র-জনতা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রামরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকসহ নাম না জানা অনেক বীর সন্তান। এভাবে মাতৃভাষার জন্য রক্তদান বা শাহাদতবরণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় উৎসর্গকৃত তাজা রক্তের বদৌলতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে এবং রক্তে রঞ্জিত ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় ভূষিত হয়। আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি এবং মহান আল্লাহর বাণী পবিত্র কোরআন ও রাসুলের সুন্নাহর মর্মার্থ মাতৃভাষা বাংলায় শিখতে পারছি। সে জন্য মহান আল্লাহর দরবারে সব ভাষাশহীদের মাগফিরাত কামনা করি। ইসলামে শহীদদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তারাও শহীদ। মহান আল্লাহতায়ালা শহীদদের ব্যাপারে ইরশাদ করেন- তোমরা তাদের (শহীদদের) মৃত বলো না। তারা আল্লাহর কাছে জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে রিজিকপ্রাপ্ত।
তাই আসুন! মাতৃভাষার বিশুদ্ধ চর্চা ও প্রয়োগে সচেষ্ট হই। যারা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে শাহাদতবরণ করেছেন, তাদের রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
মন্তব্য করুন