
১৯৪০-এর দশক শিল্প ইতিহাসের জন্য যতখানি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, তার ধারণা আগে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের দুঃসহ চেহারা কারোই অজানা নয়, তবে চলি্লশের দশকে স্বদেশী আন্দোলন রক্তক্ষয় হয়ে উঠেছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল বৃহত্তর জাতি। সেই সংকট শিল্পেও নানা আঙ্গিকে উঠে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তেতালি্লশের মন্বন্তর শিল্পীদের মনে গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল। সাম্প্রদায়িক সংকট থেকে মুক্তি আর স্বাধীনতা নতুন দেশ-জাতিকে বিশ্বে পরিচিত করে তুলেছিল, কিন্তু বিপর্যস্ত এই সময় থেকে উত্তরণে অনেকটা পথ পেরোতে হয়েছিল শিল্পীদের। স্বদেশ চেতনা ও নব্যভারতীয় ধারা এই দুইয়ের সংকট থেকে শিল্পীরা নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন কতখানি সে প্রশ্ন এখনো রয়েছে। একদিকে নন্দলাল বসু ও তার ঘরানা অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শান্তিনিকেতন এ দুইয়ের মধ্যেই আবদ্ধ সে সময়ের শিল্পচর্চা! কিন্তু শিল্পী বিনোদ বিহারী এবং রাম কিঙ্কর- তারা দু'জনই দেশজচেতনা ধারণ করে আধুনিকতাকে সংমিশ্রণ করেছেন তাদের শিল্পকর্মে। চলি্লশ দশকের শিল্পীদের শিল্পশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিল্পের দেশীয় নন্দনতত্ত্বের উপলব্ধি ঘটেছিল। আর চলি্লশের দশকে সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক দৈন্য লক্ষণীয় ছিল। শিল্পীদের মধ্যে বামপন্থি চেতনা ও অবমুক্তির পথ, উত্তরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। শিল্পী জয়নুল আবেদিন, সোমনাথ হোড়, চিত্তপ্রসাদ প্রমুখের শিল্পকর্ম তারই ধারাবাহিকতা ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্পী একত্র হয়ে নিজস্ব ধারা তৈরির চেষ্টায় ছিলেন। এমএফ হুসেন, সুজা, পরিতোষ সেন, অতুল বসু, হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার প্রমুখ। আধুনিকতা আর সাম্রাজ্যবাদকে এড়িয়ে যাওয়া আদৌ কি সম্ভব হয়েছিল শিল্পে? সে সময়ের শিল্পীরা অনেকেই পাশ্চাত্য শিল্পের ধরনকে আরাধ্য করেছেন। বিমূর্ততার আশ্রয় নিয়েছেন আবার শুধুই পরিবেশ, লোকজ ফর্ম, নকশা নিয়ে এঁকেছেন; তাই ভীষণভাবে দ্বান্দ্বিক অবস্থান তৈরি হয়েছিল শিল্প ক্ষেত্রে। এ সময় শিল্পী রামকিঙ্কর তার অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি একাধারে রবীন্দ্রনাথ এবং নন্দলালের কাছ থেকে শিল্পী দীক্ষা গ্রহণ করেন আর আঙ্গিক নিজে নির্মাণ করেন। তিন স্পষ্টতই বলেন, 'আমাকে অনেকে বলে, পশ্চিমের শিল্পীদের প্রভাবে আঁকি। কিন্তু আমার ধারা তো এ দেশের ধারা। এ দেশের শিল্প কখনো নকল করেনি। ছন্দ হলো তার ভেতরকার কথা। পুজোর ঠাকুর মূর্তির কথা যদি ছেড়ে দাও, আমাদের দেশের মূর্তির মোদ্দাকথা হচ্ছে স্ট্রাকচার, ছন্দময় রূপগঠন।' (মহাশয়, আমি ছান্দিক রূপকার মাত্র-পৃষ্ঠা-৪৭)
১৯৪১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি মুখাবয়ব নির্মাণ করেন রামকিঙ্কর। কবি শোকসভায় একটি ভাষণ পড়বেন, তাই দুঃখ ভারাক্রান্ত মন; সে সময় দ্রুত কিছু স্কেচ করেছিলেন শিল্পী রামকিঙ্কর। এক অপূর্ব অভিব্যক্তিময় অবয়ব উঠে এসেছে ভাস্কর্যে। অমসৃণ বুনটে পরিপূর্ণ আলোছায়ার দোলাচল।
১৯৫৬ সালে নির্মিত অপর গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য 'কলের বাঁশি'। সিমেন্টে নির্মিত কলা ভবনের সামনে স্থাপিত এ ভাস্কর্য। এখানেও সাঁওতাল যুবতী কাজের ডাকে ছুটে যাচ্ছে, তেমনই একটি গল্প। ভারতের শিল্পচর্চায় এমন ন্যারেটিভ ভাস্কর্যের উৎকর্ষ রামকিঙ্করের আগে দেখা যায়নি। তিনি সাধারণ জনজীবন, পরিবেশকে রূপায়ণ করেছেন তার অপূর্ব শৈলীতে। তিনি ভারতীয় ধ্রুপদী ভাস্কর্যের ধারণাকে নিজস্ব মেধা ও মননে উপস্থাপন করেছেন সর্বদা। তার চিন্তায় স্বদেশ এবং বিশ্ব ভীষণভাবে পরিপূরক ছিল। এ ছাড়াও সামাজিক দায়বদ্ধতা তাকে তাড়িত করেছে শিল্প নির্মাণে।
চলি্লশের দশকের শিল্পকলার কিউবিজম ও এক্সপ্রেশনিজমের প্রভাব চোখে পড়ে। এই প্রভাবকে শিল্পীরা নিজেদের পরিবেশ, অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার করেছেন। শিল্পী রামকিঙ্করের কাছে জীবন ও তার পারিপাশর্ি্বক অভিজ্ঞতা ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পী হতে হলে সেটা জীবনমুখী হতে হবে বলেই তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি আঙ্গিকের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের প্রভাবকে কতটা অগ্রাহ্য করেছেন সে আলোচনার চেয়ে প্রাচ্যকে কতখানি তাঁর শিল্পে ধারণ করেছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
রামকিঙ্করের ছবিতে বাকুরার অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে। শান্তিনিকেতনে তিনি গুরুদেব ও নন্দলালের সানি্নধ্যে এসে জীবনবোধকে আরো সম্প্রসারিত করেছেন। শান্তিনিকেতনের সাঁওতাল জীবন তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। ১৯৪৮ সালে অঙ্কিত 'বিনোদিনী' শিল্পী রামকিঙ্করের এক অনবদ্য সৃষ্টি। নারী অবয়ব এঁকেছেন সোজাসাপ্টাভাবে। দৃষ্টিতে রয়েছে একাগ্রতা। আঙ্গিকে পাশ্চাত্যের ভাব থাকলেও বিষয়-উপস্থাপনায় প্রাচ্যের সরলতা উপস্থিত। রামকিঙ্করের চিত্রী পরিচয়কে দাপিয়ে গিয়েছে ভাস্কর হিসেবে খ্যাতি লাভ। তাঁর নির্মিত ভাস্কর্যের পূর্বেও অনেক ভাস্কর ছিলেন কিন্তু ভারতীয় ঐতিহ্যকে আধুনিকতার সাথে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম তেমন কেউ ছিলেন না। তিনি ১৯৩৫ সালে 'সুজাতা' নির্মাণ করেন সিমেন্ট কংক্রিটে। বৃক্ষের আদলে এক যুবতীকে গড়েছেন শিল্পী রামকিঙ্কর। দীর্ঘায়িত অবয়ব যা প্রকৃতি থেকে পৃথক করা দুুরূহ, নারীদেহের সৌন্দর্যের বিশেষিত রূপ যা একান্তই প্রাচ্যের- তেমনই এক অনুভূতি 'সুজাতা'।
১৯৩৮ সালে নির্মাণ করেন 'সাঁওতাল পরিবার'; এই ভাস্কর্য তাকে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর উপাধি এনে দিয়েছে। সাধারণ একটি বিষয়কে তিনি ভাস্কর্যে রূপ দিয়েছেন, কাজ শেষে একটি সাঁওতাল দম্পতি বাড়ি ফিরছে, নারীর কাঁধ থেকে ঝোলানো দড়ির খাঁচায় শিশু, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বহন করছেন দম্পতি আর সঙ্গে রয়েছে পোষা কুকুর।
জনজীবনকে ভাস্কর্যে নির্মাণের ভাবনায় রামকিঙ্কর অন্য অনেকের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। শান্তিনিকেতনের কলা ভবনে নির্মিত এই ভাস্কর্যের ধরনটাই ভীষণ ভিন্ন। পরিবেশ ভাস্কর্য হিসেবে বিবেচিত এই ভাস্কর্য ভারতীয় শিল্পে নতুন মাত্রা তৈরি করে। রামকিঙ্কর নন্দলাল বসুর ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তাঁর শিল্প দর্শন ভীষণভাবে ভিন্নতর ছিল। আধুনিক শিল্পকে গ্রহণে এবং স্বদেশ চেতনাকে তার সঙ্গে সমন্বয় করার দৃষ্টিভঙ্গি স্বতন্ত্র ছিল। তাঁর এই পরিবর্তনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। রবীন্দ্রনাথ কখনোই স্বাধীন চেতনা বা দৃষ্টিভঙ্গিকে বাধাগ্রস্ত হতে দিতেন না। বরং ভাবনার জানালাকে প্রসারিত করতে সহায়তা করেছেন। বিশ্বভারতীতে তিনি উন্মুক্ত করেছেন জ্ঞানের শাখা-প্রশাখাকে। মাত্র বিশ্বং ভবত্যেকনিরম'। অর্থাৎ বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানকে সংহত করার এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ১৯২৪ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজেও চিত্রচর্চা শুরু করেন কবিতার পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি দিয়ে।
তাঁর চিত্রমালায় পাশ্চাত্যের অভিব্যক্তিবাদের ধারণা এবং আদিমতার সংমিশ্রণ ঘটেছিল, যা ভারতীয় চিত্রকলার নতুন অধ্যায়। জীবনবোধকে বিশ্লেষিত করেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে, সহযাত্রী হিসেবে বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্কর পরবর্তীতে এসেছেন। বাঁকুড়ার দরিদ্র পরিবারের সন্তান রামকিঙ্কর। শৈশব-কৈশোরের স্বদেশচেতনা প্রাসঙ্গিকভাবেই শিল্প সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলেছে। আর সেই শিল্পে নিমগ্ন কিশোর শান্তিনিকেতন এসে নতুন পৃথিবীর দেখা পেয়েছেন। কলাভবনের শিল্প শিক্ষা পদ্ধতির উদারতা তৈরি করেছে অনন্য রামকিঙ্কর বেইজকে। প্রকৃতি, নির্জনতা, সংবেদনশীল মন, প্রেম শিল্পে নতুন আলোড়ন তৈরি করেছে। ভাস্কর্যের প্রতি আলাদা আকর্ষণ শৈশব থেকেই ছিল রামকিঙ্করের মধ্যে, তাই সরাসরি কিউবিজম থেকে তাঁর ছবিতে গাঠনিকতার ধারণা এসেছে, সেই ভাবনা অবান্তর। বরং তিনি ভাস্কর্যের ত্রিমাত্রিকতার অভিজ্ঞতাকে আধুনিক বিশ্লেষণে পরিস্ফুট করেছেন। তাঁর দেশাত্মবোধ স্বাদেশিকতায় আটকে থাকেনি। তার জীবনোপলব্ধিকে তিনি প্রকাশ করেছেন। আঙ্গিকে বৈচিত্র্য এনেছেন, যা সহজাত ছিল। রামকিঙ্করের ভাস্কর্যে আদিমতা প্রবল, আবার ভারতীয় ধ্রুপদী প্রবণতাও রয়েছে আর যুক্ত হয়েছে অভিব্যক্তি_ এসব মিলে শিল্প আর জীবন একাকার হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় শিল্পকলায় রামকিঙ্কর বেইজ এক অনন্য দ্যুতি। তিনিই ভারতীয় ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে প্রথম স্বতন্ত্র ভাষা তৈরি করেছেন। দ্বিমাত্রিকতা নিয়ে নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ বা নতুন ধারা তৈরি করেছেন বহুশিল্পী। কিন্তু ভাস্কর রামকিঙ্কর ত্রিমাত্রিকতার স্বতন্ত্র চরিত্র নির্মাণ করেছেন। লৌকিক জীবন আর আধুনিক বাস্তবতার ভাস্কর্যের সমীকরণে নতুন রূপকল্প সৃষ্টি হয়েছে, যা ঐতিহ্যবাহী। চলি্লশ দশকের পুরোধা ব্যক্তিত্ব শিল্পী রামকিঙ্কর।
মন্তব্য করুন