অমিতোষ পাল |
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২১ । ০০:০০
আপডেট: ৩১ জুলাই ২১ । ০২:২৬
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২১ । ০০:০০ । আপডেট: ৩১ জুলাই ২১ । ০২:২৬
অনেক তো হলো- রাজধানীর নালা-নর্দমায় গাপ্পি মাছ, ব্যাঙের পোনা, হাঁস ছাড়া, ওষুধ ছিটানো তো আছেই, তবুও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না রাজাধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ডেঙ্গু রোগীও বাড়ছে। চেষ্টা চলছে, তবে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন নাগরিকরা যেন সচেতন ও সক্রিয় হয়ে নিজ নিজ জায়গা পরিস্কার রাখে।
চলতি মৌসুমে হাসপাতালের হিসাবে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি এখন পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি। এর অর্ধেকের বেশি চলতি মাসেই এবং ৯৯ শতাংশই ঢাকা নগরে। চারজনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে। প্রতিদিনই রোগী বাড়ছে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
নানা চেষ্টা :ডেঙ্গু বহনকারী এডিস মশা দমনের জন্য আগের অকার্যকর ওষুধের বদলে নতুন ওষুধের প্রয়োগ, জলাশয়-নর্দমায় ব্যাঙের পোনা, গাপ্পি মাছ, তেলাপিয়া মাছ ও হাঁস ছাড়া, পরিচ্ছন্নতা, ভবনে মশা প্রজননের অনুকূল পানি জমে থাকে কিনা দেখতে চিরুনি অভিযান, দুই মেয়রেরও ব্যক্তিগত তদারকি ইত্যাদি প্রচেষ্টাতেও তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্নিষ্টরা জানাচ্ছেন, মশা বদ্ধ জলাশয়ে ডিম পাড়ে। রাজধানীতে স্বাস্থ্যকর পুকুর-সরোবর থাকলেও বদ্ধ জলাশয় প্রচুর। খাল, বক্স কালভার্ট, উন্মুক্ত ড্রেন, স্যুয়ারেজ ড্রেনগুলোতে পানির প্রবাহ না থাকায় বছরের বেশিরভাগ সময় মশা প্রজননের অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন জলাশয়, বক্স কালভার্ট ও ড্রেনগুলোতে গাপ্পি মাছ ছেড়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল গাপ্পি পানির ওপর ভেসে থাকা লার্ভা খেয়ে ফেলবে। ২০১৮ সালে মার্চে কাজী আলাউদ্দিন রোডের ড্রেনে ১০ হাজার গাপ্পি ছেড়ে বলেছিলেন, রাজধানীর ৪৫০ কিলোমিটার জলাশয়ে ১৫ লাখ ছাড়া হবে। কিন্তু তেমন সুফল না পাওয়ায় সে প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে।
বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের জুনে রমনা পার্কের লেকে বেশকিছু হাঁস অবমুক্ত করেন। সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি হাঁস মশার বংশবিস্তার রোধ করবে ভাবা হয়েছিল। দৃশ্যমান কোনো কাজ দেয়নি। গত মার্চে বক্স কালভার্ট-ড্রেনে ১০ হাজার ব্যাঙ ছাড়া হয়। মশার লার্ভা ব্যাঙের অতি প্রিয়। কিন্তু মশা কমলো না। কয়েক হাজার তেলাপিয়া মাছও ছাড়া হয়। কর্মসূচিটি এখনও স্বল্প পরিসরে চলছে। প্রতিনিয়ত সকাল-বিকেল ওষুধ স্প্রে করাও হচ্ছে। এত সবেও মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
ওষুধ ছিটিয়ে ফল না পাওয়ার কারণ হিসেবে দীর্ঘদিনের অভিযোগ হচ্ছে, কেনাকাটায় দুর্নীতির কারণে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ। এ অবস্থায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গত বছর অক্টোবর মাসে বিভিন্ন জলাশয়ে নোভালুরন নামের একটি ট্যাবলেট ছেড়েছিল। ইংল্যান্ড থেকে ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে আমদানি করা ওই ওষুধ ব্যবহারেও তেমন সুফল মেলেনি। ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ এই ওষুধটির ওপর চলতি মৌসুমের জন্য ভরসা করছিল। এখন মনে করা হচ্ছে, নিয়মিত ওষুধ ছিটিয়ে, পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করে ও নগরবাসীকে সচেতন করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া বিকল্প নেই।

আবার এমন অনেক স্থান আছে যেখানে মশকনিধন কর্মীরা পৌঁছাতে পারেন না। ফলে ওই সব স্থানে ওষুধও ছিটানো সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় ড্রোনের ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছিল ডিএনসিসি। একেকটি ড্রোন ৩০ লিটার পর্যন্ত ভার বহন করতে পারবে। ড্রোনের সঙ্গে ক্যামেরা সংযুক্ত থাকবে। একটি কন্ট্রোল রুম থেকে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ থেকে ওপর থেকে মশা মারার ওষুধ ছিটানো হবে। সেই উদ্যোগও সফল হয়নি। পরে মাঝেমধ্যেই চিরুনি অভিযান পরিচালনা শুরু করে ডিএনসিসি। একেকটি ওয়ার্ডকে চার-পাঁচটি ব্লকে ভাগ করে একসঙ্গে ঝটিকা অভিযান চালানো হয়। সকাল-বিকেল লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড অর্থাৎ মশার শূককীট মারার ওষুধ ও পূর্ণাঙ্গ মশা মারার ওষুধ ছিটানো হয়। চলতি বছরে চারটি চিরুনি অভিযান চালিয়েছে ডিএনসিসি। প্রতিটিই ১০ দিনব্যাপী। বর্তমানেও একটি অভিযান চলছে।
গত মাসে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম কাউন্সিলরদের ডেকে প্রতিটি ওয়ার্ডের কোথায় কোথায় মশার বংশবিস্তারের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয় সেটি চিহ্নিত করার দায়িত্ব দেন। বর্তমানে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে প্রতি ওয়ার্ডে চলছে বাড়ি মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে বৈঠক। সেখানে কাউন্সিলররা বাসাবাড়ি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, জমা পানি প্রতি তিন দিনে একবার ফেলে দেওয়াসহ নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু ফলাফল দেখতে পাওয়ার মতো কাজ হচ্ছে না।
কী করণীয়: ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ বলেন, এডিস মশার বংশ বিস্তারের জন্য যেসব অনুকূল পরিবেশ- উচ্চ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও মাঝেমধ্যে বৃষ্টি সবই এখন আছে। আবার দেখা গেছে, এক বছর পর পর এডিস মশার প্রকোপ বেশি হয়। ২০১৭ সালে বেশি হয়েছিল। ২০১৮ সালে কম ছিল। ২০১৯ সালে বেশি হয়েছিল। ২০২০ সালে কম ছিল। তাই আগাম ধারণা ছিল এবার এডিস মশা বাড়বে। সে অনুযায়ী ডিএসসিসি তৎপর ছিল। বছরব্যাপী মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নিয়েছিলেন মেয়র। জনবল বাড়ানো, প্রশিক্ষণ দেওয়া, ভালো ওষুধ দেওয়া, যন্ত্রপাতি বাড়ানো ইত্যাদি উদ্যোগ ডিএসসিসি নিয়েছে। আগে একটা টিম কাজ করত। এখন দুটি টিম সকাল-বিকেল কাজ করে। প্রতি ওয়ার্ডে আটজন মানুষ, ৮টা মেশিন, পাঁচবার প্রতিটি মেশিন রিফিল করে স্প্রে করা হয়। তার মানে প্রতিদিন ৩০ হাজার মেশিন স্প্রে করে। এ ছাড়া জানুয়ারি থেকে মোবাইল কোর্ট, মাইকিং, লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। আগে বাসাবাড়ি পরিচ্ছন্ন করার জন্য একটা নামমাত্র ফি ধরা হয়েছিল। পরে সে ফি বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, 'তার পরও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এত বড় একটা শহরে মানুষ যদি সচেতন না হন, তাহলে কাজটা করা কঠিন হয়ে পড়ে।'
ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, 'ডিএনসিসি এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কম। তার পরও এই অবস্থার পেছনের কারণ, আমরা মানুষকে ঠিকমতো সচেতন করতে পারছি না। নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে এডিস মশা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে রিহ্যাবের (আবাসন ব্যবসায়ীদের সমিতি) সঙ্গে কথা বলছি। তাদের জরিমানা করছি। তার পরও পানি জমে থাকা পাওয়া যাচ্ছে। বাসাবাড়ির কিছু লোক সচেতন হয়েছেন। কিন্তু সরকারি ভবন ও নির্মাণাধীন ভবনকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না। ওইসব এলাকায় তারা আমাদের ঢুকতেও দেয় না, নিজেরাও পরিস্কার করে না। তবে আমরা যে কাজ করছি তার প্রতিফলন কিছু দিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে।'
এই পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও মশক বিশেষজ্ঞ ড. কবিরুল বাশারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি তার পরামর্শ ব্যক্ত করে সমকালকে বলেন, কাউন্সিলরদের সহযোগিতায় ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি করে ভাগ করতে হবে। প্রতি ব্লকে স্থানীয় গুণীদের দিয়ে কমিটি করতে হবে। ওই কমিটির লোকজন দেখিয়ে দেবে কোথায় কোথায় এডিস মশার লার্ভা ও বংশ বিস্তার-উপযোগী পরিবেশ আছে। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা সেগুলো ঠিক করবেন। বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা পাত্রগুলো ফেলে দিতে হবে। ফেলা না গেলে সেগুলোকে উল্টিয়ে রাখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে ফগিং (মেশিনে ওষুধ ছিটিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন করা) করে দেবে। এভাবে ১০ দিনের একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম করতে হবে। কতটুকু কাজ হলো সেটার একটা মূল্যায়নও থাকতে হবে। প্রয়োজনে মেয়ররা না জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক পরিদর্শনে যাবেন। অলিগলিগুলো হেঁটে দেখবেন কোথাও পাত্র পড়ে আছে কিনা। যদি পাত্র পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে কাজ ঠিকমতো হয়নি। পাত্র পাওয়া না গেলে বুঝতে হবে কাজ ভালো হয়েছে। দ্রুত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এখন এ ছাড়া কোনো সমাধান নেই।
বিষয় : এডিস
মন্তব্য করুন