বিশ্বে নতুন করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনা সংক্রমণ; কোথাও তৃতীয় ঢেউ, কোথাও চতুর্থ। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন। ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে শনাক্ত হয়েছে ৩১ লাখ ৯৯ হাজার মানুষ এবং মৃত্যুবরণ করেছেন আট হাজার ৩৯২ করোনা রোগী। যুক্তরাষ্ট্রে করোনার প্রকোপ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের মর্মান্তিক মাইলফলক স্পর্শ করেছে দেশটি। প্রতিবেশী ভারতে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শেষ ২৪ ঘণ্টায় ৩৮০ জন মারা গেছেন। শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। এ ছাড়া ভারতের ২৭টি রাজ্যে পাঁচ হাজার ৪৪৮ জনের মধ্যে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। ওমিক্রনের সংক্রমণ আগামী ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে ইউরোপের অর্ধেক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশেও তা দ্রুত ছড়াচ্ছে। ১৪ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

আমরা জানি, ওমিক্রন অর্থাৎ করোনার নতুন এ ধরনটি সর্বপ্রথম শনাক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় গত নভেম্বরে। গ্রিক বর্ণমালার ১৫তম অক্ষর 'ওমিক্রন' অনুযায়ী করোনার নতুন এ ধরনের নামকরণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সেই সঙ্গে ওমিক্রনকে 'ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন' (উদ্বেগজনক ধরন) হিসেবে ঘোষণা করে সংস্থাটি। গত দেড় মাসে অন্তত ১১০টি দেশে ওমিক্রনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এটি শনাক্ত হওয়ার পর করোনার এ ধরনটি নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ওমিক্রন অতিমাত্রায় সংক্রামক। পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিরাও ওমিক্রনে সংক্রমিত হতে পারেন। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যকে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে ওমিক্রন। ভারতে ওমিক্রনে মৃত্যুহার যুক্তরাজ্যের চেয়ে কম। ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও স্পেনে দৈনিক ওমিক্রনের সংক্রমণ চূড়ায় উঠেছে যথাক্রমে ২৪, ২২, ৩২ ও ২৬তম দিনে। অর্থাৎ, গড়ে ২৫ দিনে ওমিক্রনের সংক্রমণ সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাচ্ছে। এই নতুন ধরনের প্রতিরোধে কার্যকর টিকা আগামী মার্চ মাসে প্রস্তুত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠান ফাইজার। গত সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলবার্ট বোরলা বলেন, 'আগামী মার্চে এই ভ্যাকসিনটি প্রস্তুত হয়ে যাবে। আক্রান্ত হওয়ার পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া ঠেকাতে বিদ্যমান দুই ডোজ টিকার প্যাকেজটি এবং একটি বুস্টার ডোজ এখনও মানুষকে যথেষ্ট সুরক্ষা দিচ্ছে।' এদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির সঙ্গে পৃথক এক সাক্ষাৎকারে মডার্নার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টেফান ব্যানসেল জানিয়েছেন, তারা করোনা টিকার একটি বুস্টার ডোজ তৈরির কাজ করছেন। এটি শেষ হলে টিকার ওই বুস্টার ডোজটি ওমিক্রন ধরনসহ ভাইরাসের অন্যান্য সম্ভাব্য ধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর হবে।

আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণের হার অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে। এ পর্যন্ত সংক্রমণের যে হার লক্ষ্য করা গেছে, তা উদ্বিগ্ন না করে পারে না। আরও উদ্বেগের কারণ হলো, এখনও সচেতনতা-সতর্কতায় যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে জনপরিসরে। লক্ষ্য করা গেছে, এখন পর্যন্ত সংক্রমিতদের মধ্যে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনে আক্রান্তের হার ১৫ শতাংশ। বাকি ৭৫ শতাংশ রোগী অন্যান্য ধরনে আক্রান্ত। জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জার তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার পর্যন্ত দেশে মোট ৩৩ জন ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এমতাবস্থায় জরুরি হলো বিমান কিংবা অন্য পথে দেশে যারাই আসবেন তাদের পরীক্ষার পাশাপাশি যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় নেওয়া। অতীতের মতো ভুলের কারণে যেন পরিস্থিতি বিস্ম্ফোরণোন্মুখ না হয়, এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি। কোনো রকম উদাসীনতা বা দায়িত্বহীনতা কাম্য নয়।

প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশে প্রবেশ করছেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রবেশপথে র‌্যাপিড পিসিআর মেশিন বসাতে হবে। পরীক্ষায় যারা কভিড-১৯ পজিটিভ হবেন, তাদের করতে হবে কোয়ারেন্টাইন। তা ছাড়া মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও বিদেশ থেকে আসা প্রবাসীদের অ্যান্টিজেন পরীক্ষা এরই মধ্যে বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। আমাদের স্মরণে আছে, গত বছর ভারতে যখন করোনার ডেলটা ধরন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন আমরা সীমান্তসহ ভারত থেকে আগতদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় অনেকটাই রেহাই পেয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিস্তৃত সীমান্ত। তাই অধিক সতর্কতা এ জন্যও জরুরি।

চলতি বছর মার্চ মাসের মধ্যে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এ জন্য টিকাদান বাড়াতে দেশব্যাপী ৭১৮টি স্থায়ী এবং ৬০৫৮টি অস্থায়ী কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এসব কেন্দ্রের পাশাপাশি এক লাখ ২৪ হাজার ৪৯৭টি অস্থায়ী কেন্দ্রে টিকাদানও শুরু হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে যে ব্যক্তি যে টিকাই পেয়ে থাকুন, বুস্টার হিসেবে দেওয়া হবে ফাইজার, মডার্না অথবা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। দেশে এ পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না, সিনোফার্ম, সিনোভ্যাক মিলে টিকা এসেছে ২৩ কোটি ৫৯ লাখ ৪১ হাজার ২৯০ ডোজ। এর মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছেন সাত কোটি ৯০ লাখ দুই হাজার ২৪৩ জন। দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন পাঁচ কোটি ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার ১৭১ জন। বুস্টার ডোজ পেয়েছেন চার লাখ ২৮ হাজার ৫৯৬ জন। সব মিলিয়ে দেশে এ পর্যন্ত ১৩ কোটি ৪২ লাখ ৯৭ হাজার ১০ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মজুদ টিকার পরিমাণ ১০ কোটি ১৬ লাখ ৪৪ হাজার ২৮০ ডোজ। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে টিকা এসেছে ২৩ কোটি ৫৯ লাখ ৪১ হাজার ২৯০ ডোজ। দেখা যাচ্ছে, টিকার মজুদ নিয়ে আপাতত কোনো সংকট নেই। তাই সমগ্র জনগোষ্ঠীকে যত দ্রুত টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে, সংক্রমণ ও ঝুঁকি ততই হ্রাস পাবে।

১৪ জানুয়ারি সমকালে শীর্ষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে এখনও সংক্রমণে প্রাধান্য ডেলটা ধরনের। ধরন যা-ই হোক, এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সর্বাবস্থায় জরুরি জনসচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলা। পরিস্থিতি ফের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে জীবন, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য- সবই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সবাইকে সরকার ঘোষিত ১১ দফা স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ পালন করতে হবে। নিজে সুরক্ষিত না থাকলে অন্যেরা হয়ে পড়বে অরক্ষিত। তাই ব্যক্তির দায়িত্বের কথা ব্যক্তিকেই স্মরণ রাখতে হবে। করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরন বিপজ্জনক, বিশেষ করে যারা টিকা নেননি তাদের জন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বিশ্বজুড়ে করোনার ওমিক্রন ধরনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় দেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকাদান কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি মনে করি। সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলার পাশাপাশি এ কার্যক্রমে জনপ্রতিনিধি, সমাজের সচেতন মহলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের যুক্ত করা দরকার। নতুন ধরন আমাদের সামনে ছুড়ে দিয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে সবাইকে হতে হবে সচেতন ও দায়িত্বশীল।

এ ব্যাপারে আমার পরামর্শ- ১. মাস্ক ব্যবহার, বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতিতে লেভেল-৩ মাস্কিং অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। অফিসে একা থাকলে এবং নিজের বাড়িতে কেবল মাস্ক খোলা যাবে। এ ছাড়া আর কোথাও মাস্ক খোলা যাবে না। ২. করোনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। ৮৫২টি করোনা পরীক্ষাকেন্দ্রকে আরও সক্রিয় করতে হবে। প্রয়োজনে আরও বাড়াতে হবে পরীক্ষাকেন্দ্র। ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বাংলাদেশে এ সময়ে সাধারণত মানুষ ঠান্ডাজনিত রোগে ভোগে। এ কারণে এমন উপসর্গ মানুষ খুব গুরুত্ব দেয় না এবং করোনা পরীক্ষায় অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ৩. পরীক্ষার পর রোগ শনাক্ত হলে দ্রুত কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যতদিন সম্ভব খোলা রাখতে হবে, তবে পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। যদি সংক্রমণ আরও বেড়ে যায়, তখন দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ওমিক্রনে অল্পবয়স্ক এবং টিকা গ্রহণকারীরাও সংক্রমিত হয়। ৫. টিকা কার্যক্রম জোরদার ও ত্বরান্বিত করতে হবে। টিকাগ্রহীতাদের সংক্রমণের হার একেবারেই কম। ৬. চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং তাদের উৎসাহিত করতে হবে। ৭. দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা সহজলভ্য ও নিশ্চিত করা জরুরি। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতার আলোকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা প্রয়োজন।

বিগত দুই বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে, যারা শুধু যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তাদের জীবনযাপন স্বাভাবিক রেখেছে। আমাদেরও সে পথে হাঁটতে হবে। আবার যদি লকডাউন দেওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে পিছিয়ে যাবে আমাদের সব অগ্রযাত্রা। যে কোনো নতুন বিধিনিষেধ আরোপে সব সময় কিছুটা অসুবিধা হয়। ধৈর্য ধরে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তা সুদূরপ্রসারী কাজ দেয়। আমাদের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা দিয়ে নিশ্চয় আমরা এ সংকট মোকাবিলা করতে পারব। সরকার যথেষ্ট সময়োচিত দায়িত্ব পালন করছে। আমাদেরও সহযোগিতার হাত বাড়ানো প্রয়োজন নিজেদের স্বার্থেই।

অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান :সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন