২০০৭ সালের ঘটনা। তখন ক্লোজআপ ওয়ান সংগীত প্রতিযোগিতার শিল্পীদের কণ্ঠে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটা আঞ্চলিক গান রিমেক্স করা হয়েছে। কালজয়ী সংগীতজ্ঞ এমএন আখতারের 'কইলজার ভিগর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে', সনজিত আচার্য্যের 'সাম্পানওয়ালা' ছবির গানগুলোও ক্লোজআপ তারকারা নতুন সংগীতায়োজনে গেয়েছেন। দারুণ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে সেসব গান। পাশাপাশি হাবিবের সংগীতায়োজনে লন্ডন প্রবাসী শিল্পী শিরিনের কণ্ঠে চট্টগ্রামের কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ আবদুল গফুর হালী রচিত, কল্যাণী ঘোষের গাওয়া 'পাঞ্জাবিওয়ালা' ও শেফালী ঘোষের গাওয়া 'মনের বাগানে' গান দুটি সুপারহিট হয়েছে। ওই সময় একদিন শিল্পী এমএন আখতার ও আবদুল গফুর হালী আমাকে তাদের কিছু ক্ষোভের কথা বললেন। তারা জানালেন, তাদের গানগুলো যে রিমেক করা হয়েছে তাতে তাদের আপত্তি নেই, কিন্তু রিমেক করার আগে তাদের অনুমতি নেওয়া হয়নি, কোনো সম্মানীও দেওয়া হয়নি বরং কিছু ক্ষেত্রে গানগুলোর কথা ও সুরে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা অন্যায়। তখন প্রবীণ দুই শিল্পীর প্রতিবাদের কারণে সংশ্নিষ্টরা নড়েচড়ে বসেন; ক্ষেত্রবিশেষে মূল রচয়িতা ও শিল্পীদের কাছ থেকে নতুন করে অনুমতি নেন এবং সম্মানীও দেন। কিন্তু চট্টগ্রামের গান নিয়ে বিকৃতির অভিযোগ থামছে না। সাম্প্রতিক সময়ে জাজ মাল্টিমিডিয়া প্রযোজিত 'পোড়ামন-২'-এ জনপ্রিয় গীতিকার শাহ আলম সরকার রচিত এবং কণা ও ইমরানের গাওয়া 'ওহে শ্যাম তোমারে আমি নয়নে নয়নে রাখিব/অন্য কারে না আমি চাইতে দেব' গানটি নিয়ে নকলের অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামের লিজেন্ড শিল্পী সঞ্জিত আচার্য্য ও কল্যাণী ঘোষ বলছেন, চট্টগ্রামের অর্ধশত বছরের জনপ্রিয় ও প্রচলিত মাইজভাণ্ডারী ঘরানার 'নয়নে নয়নে রাখিব রে শাম তোরে পাইলে/নয়নে নয়নে রাখিব/অন্য কারে চাইতে না দিব রে শাম তোরে পাইলে' গানটিকে নকল করে উপরিউক্ত গানটি লেখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আজ থেকে ২৫ বছর আগে 'নয়নে নয়নে রাখিব' গানটি আমি প্রথম শুনেছিলাম লোহাগাড়ার দক্ষিণ শুকছড়ি দরবারে। পরে কালজয়ী সংগীতজ্ঞ আবদুল গফুর হালী আমাকে বলেছিলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি এই গানটি পটিয়ার আমির ভাণ্ডারের ছেমা মাহফিলে শুনেছেন। তার মতে, এই গানটি আমির ভাণ্ডারেরই প্রেম-গীতি। তবে কালের প্রবাহে এই গান মাইজভাণ্ডার দরবারসহ বিভিন্ন দরবারের ছেমা মাহফিলে গাওয়া হতে থাকে। চট্টগ্রামে এই গান করেননি এমন সুফি ঘরানার শিল্পী একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বছর বিশ আগে জনপ্রিয় মরমি শিল্পী সেলিম নিজামীর কণ্ঠেও গানটি রেকর্ড হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, 'নয়নে নয়নে রাখিব রে শাম তোরে পাইলে' গানের সুরের অনুকরণে রচিত হয়েছে আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষের গাওয়া ও কালজয়ী সংগীতজ্ঞ মোহন লাল দাশ রচিত চিরসবুজ আঞ্চলিক গান 'ওরে সাম্পানওয়ালা তুঁই আমারে করলি দিওয়ানা'।
শাহ আলম সরকার রচিত গানে চট্টগ্রামের গানটির একটি অন্তরা প্রায় হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে- 'প্রেম বাগানের ফুলও তুমি/তুলিয়া এনেছি আমি/মালা গাঁথি গলে পড়িব'। শাহ আলম সরকার কেবল প্রেমবাগান না বলে 'বাগিচার ফুল তুমি' বলেছেন। মনে পড়ে ২০০০-২০০১ সালের দিকে এই গানটির মুখ ঠিক রেখে অন্তরার কথা বদলে দিয়ে দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছিলেন চট্টগ্রামেরই সন্তান রবি চৌধুরী ও ডলি সায়ন্তনী।
প্রসঙ্গত, জাজ মাল্টিমিডিয়ার আবদুল আজিজ আমাদের আবদুল গফুর হালীর একটি কালজয়ী গান 'সোনাবন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা' নিয়েও একই কাজ করেছিলেন। জাজ প্রযোজিত 'নুরজাহান' চলচ্চিত্রে গানটির মুখ ঠিক রেখে অন্তরার কথা বদলে কলকতার শিল্পী দিয়ে গাওয়ানো হয়। সেই সময় আবদুল গফুর হালী রিসার্চ সেন্টারের পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদের কারণে মিডিয়ায় বেশ আলোচনা হয় বিষয়টি নিয়ে।
আবদুল গফুর হালী রিসার্চ সেন্টারের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিন এ ব্যাপারে বলেন, 'আবদুল গফুর হালীর প্রতিটি গান আমাদের কাছে সন্তানের মতো। মারা যাওয়ার আগে গফুর হালী তার গান সংরক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আমাদের। তাই তার গান কেউ বিকৃত করলে আমরা কাউকে ছাড় দিই না।'
প্রসঙ্গত, অবস্থা বেগতিক দেখে ২০১৮ সালে আবদুল আজিজ ছুটে আসেন চট্টগ্রামের পিএইচপি হাউসে। তখন তিনি আবদুল গফুর হালী রিসার্চ সেন্টারের কর্মকর্তাদের কাছে গান নকলের ঘটনায় ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন, করেছিলেন যথাযথ প্রায়শ্চিত্তও।
এখনও হাটে মাঠে ঘাটে কান পাতলেই শোনা যায় 'ওরে সাম্পানওয়ালা' গানটি। শেফালী ঘোষের এই বিখ্যাত গানটি ছাড়া চট্টগ্রামে তো কোনো উৎসব-পার্বণ হয় না। এই গানটি নতুন সংগীতায়োজনে গেয়েছিলেন ক্লোজআপ তারকা সোনিয়া ও রাজীব। অ্যালবামটি বাজারে আসার পর 'সাম্পানওয়ালা' গানটিকে বিকৃত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মোহন লাল দাশের ছেলে স্বপন দাশ। মূল গানের একটি অন্তরা (বাহার মারি যারগৈ সাম্পান/কেনে ভাটি কেনে উজান/ঝড় তুফানে পরোয়া করে না) বাদ দিয়ে নতুন দুটো অন্তরা সংযুক্ত করা হয় (দেইখারে তোর মুখের হাসি/আমার মন হইল উদাসী... ও আহা কী রূপ মরি মরি/লাগে যেন স্বর্গের পরী...)।
সাম্পানওয়ালা চলচ্চিত্রের একটি ছাড়া সবগুলো গানের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন সনজিত আচার্য্য। গানগুলোর ভাষা পরিবর্তন করা হলেও তার অনুমতি নেওয়া হয়নি, এমনকি তার নামটিও উলেল্গখ করা হয়নি বলে জানান সনজিত আচার্য্য।
হাবিব ও শিরিনের 'পাঞ্জাবিওয়ালা' ও সালমার 'বন্ধু আইও আইও' অ্যালবামেও আঞ্চলিক গান নিয়ে বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে।'
প্রয়াত আবদুল গফুর হালী তখন এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, 'আঞ্চলিক গানের প্রতি ভালোবাসা আছে বলেই তারকা শিল্পীরা এ গান করছেন, এটা প্রশংসাযোগ্য। তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা যেন চট্টগ্রামের শিল্পী, গীতিকার সুরকারদের সম্মানটুকু দেন।' পরে হাবিব ও শিরিন গফুর হালীর প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী দেন। এ প্রসঙ্গে গফুর হালী বলেছিলেন, চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে এসে হাবিব তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, দুটি গানের যে সম্মানী দিয়েছেন।
প্রায় ৪৩ বছর আগে এমএন আখতার ও সাবিনা ইয়াসমিনের দ্বৈতকণ্ঠের 'কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে' গানটি 'বন্ধু আইও আইও' অ্যালবামে গেয়েছেন ক্লোজআপ ওয়ান সালমা। এমএন আখতারের অভিযোগ দ্বৈতকণ্ঠের চিরসবুজ এ আঞ্চলিক গানটির দুটো অন্তরা বাদ দিয়ে সালমা একাই গেয়েছেন। এতে তার অনুমতি নেওয়া হয়নি। গানটির এক পর্যায়ে 'সুন্দর সুন্দর কিস্তা হইয়ম ন হুনাইয়ম কেউরে' এর স্থানে 'সুন্দর সুন্দর গান শোনাইয়ম নিশীথ জাগিয়ারে' গাওয়া হয়েছে।' এ ব্যাপারে এমএন আখতার তখন এ প্রতিবেদককে বলেন, ''আমার লেখা 'তুমি যে আমার জীবনের উপহার', 'যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম' গানগুলো বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার হয় কিন্তু গীতিকার-সুরকার হিসেবে আমার নামটাও উল্লেখ করা হয় না।''
প্রসঙ্গত, শিল্পী সন্দীপন 'সোনাবন্ধু' গানটি অ্যালবামে দেওয়ার আগে ওই গানের গীতিকার আবদুল গফুর হালীর অনুমতি নিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে 'চাঁদ মুখে মধুর হাসি' অ্যালবামে সিরাজুল ইসলাম আজাদের 'ওরে হালা ভ্রমরা' গানটি গেয়েছেন। সেখানেও যথাযথ সম্মান দিয়েছেন গানের স্রষ্টাকে।
মন্তব্য করুন