মূল ফটক পার হলেই সোজা রাস্তা, রাস্তার দু'ধারে সারি সারি গাছ আর ফুলের বাগান। চারদিকে প্রাণ-প্রকৃতি আর সবুজের বুনন। মন জুড়ানো এই সবুজ ক্যাম্পাসের নাম চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)। এটি দেশের একমাত্র বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, যা জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ সেবা প্রদান, খাদ্য ও মৎস্যসম্পদবিষয়ক গবেষণা এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আপামর জনগণের নিরাপদ খাদ্য চাহিদা মেটানো ও বিকশিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে।

গবেষণায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি দেশজুড়ে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপন ও কভিড-১৯-এর ৩০০টি স্পাইক প্রোটিনের জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্নেষণ করে মহামারির এই দুর্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি একডোজ টিকা নেওয়ার পর করোনায় আক্রান্ত ২০০ জনের ওপর গবেষণা প্রকল্প চালানো হয়। এত দেখা যায়, টিকা নেওয়ার পর আক্রান্ত হলেও ঝুঁকি কম থাকে। চট্টগ্রামে ৯৩ শতাংশ করোনা রোগীর বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের খবর দেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা।

শুরুর গল্প :উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও জাতীয় উন্নয়নে অবদানের রূপকল্পে ১৯৯৫-৯৬ সালে মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী এলাকায় চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ নামে যাত্রা শুরু করে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নামে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। দীর্ঘদিনের আন্দোলন-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালের ৭ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি মেলে।

অনুষদ, শিক্ষা কার্যক্রম ও চিকিৎসা সেবা প্রদান:সাড়ে সাত একরের এই ক্যাম্পাসে বর্তমানে তিন অনুষদে ১৮টি বিভাগ রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্য আছে শতভাগ আবাসিক সুবিধার দুটি হল। ভেটেরিনারি মেডিসিন, ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ও মৎস্যবিজ্ঞান- তিনটি অনুষদে সেমিস্টার পদ্ধতিতে চলে শিক্ষা কার্যক্রম। এখানে অ্যানাটমি অ্যান্ড হিস্টোলজি, অ্যানিমেল সায়েন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ, ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এ বিশ্ববিদ্যলয় থেকে বর্তমানে স্নাতক, এমএস, এমপিএইচ ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। দুটি ইনস্টিটিউট ও দুটি রিসার্চ সেন্টার সমৃদ্ধ এই বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ২০ একর জায়গায় স্থাপন করেছে তাদের 'রিসার্চ অ্যান্ড ফার্ম' নির্ভর আরেকটি ক্যাম্পাস। এবার এখানে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স নামের দুটি নতুন অনুষদে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হবে। হাটহাজারী ক্যাম্পাসে ডেইরি ফার্ম, পোলট্রি ফার্ম, হ্যাচারিসহ বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের অধীনে শিক্ষকরা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এছাড়া ইন্টার্ন ও স্নাতকোত্তর ভেটেরিনারি ডাক্তারদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্দেশে ঢাকার পূর্বাচলে স্থাপন করা হয়েছে টিচিং অ্যান্ড ট্রেনিং পেট হসপিটাল ও রিসার্চ সেন্টার। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পোষা প্রাণীর উন্নত চিকিৎসা সেবাও প্রদান করা হচ্ছে এই হাসপাতাল থেকে।

ইন্টার্নশিপ ও বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ:একাডেমিক পৃষ্ঠা ২ :কলাম ১

শিক্ষার পাশাপাশি হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে ভেটেরিনারি শিক্ষায় সর্বপ্রথম ইন্টার্নশিপ কর্মসূচি চালু করে এ বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিদেশেও প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। এটি বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়-যার শতভাগ শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পাচ্ছে। সমৃদ্ধ অ্যানাটমি ও মৎস্য জাদুঘর: ক্যাম্পাসের ইউসুফ চৌধুরী ভবনের নিচতলায় রয়েছে অ্যানাটমি জাদুঘর। এখানে কাঁচঘেরা ঘরে সারাক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘদেহী এক আস্ত আফ্রিকান জিরাফ। তবে রক্ত-মাংসের নয়, শুধুই কঙ্কাল। জিরাফ ছাড়াও জাদুঘরে রয়েছে ছোট্ট ঘুঘু থেকে প্রকা-দেহী হাতি, পোষা ও বিভিন্ন বন্য প্রাণির কঙ্কাল। কঙ্কালে এই সমৃদ্ধ সংগ্রহশালার ফলে এনাটমি'র শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যবহারিক ক্লাস ও গবেষণা কর্ম পরিচালনায় বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীনে উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে ২০১৭ সালে এ জাদুঘর স্থাপিত হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে মৎস্য জাদুঘর। এখানে ৪২৫ প্রজাতির মৎস্য সংরক্ষিত আছে। এরমধ্যে ২২৫ প্রজাতির সামুদ্রিক ও ২০০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছের নমুনা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে অনেক বিলুপ্তপ্রায় মাছের নমুনা। জাদুঘরে আরও রয়েছে ৩০ প্রজাতির শামুক, ঝিনুক ও প্রবাল।

গবেষণায় সাফল্য ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড :উপাচার্য অধ্যাপক ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাস নিয়ে এ পর্যন্ত ৮ টি গবেষণা করা হয়েছে ও আরও তিনটি গবেষণা চলমান রয়েছে। শিক্ষকেরা ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন। ডিএনএ বারকোডিং প্রযুক্তির মাধ্যমে এডিস মশা শনাক্তকরণ, ছাদে রঙিন মাছ চাষের মডেল তৈরি, মুরগির উন্নত জাত উদ্ভাবন, গবাদিপশুর পুষ্টির চাহিদা পূরণে সক্ষম ক্যটল বিস্কুট আবিস্কার, এন্টিবায়োটিকের পরিবর্তে মাছের তেল ব্যবহার করে মুরগির রক্ত আমাশয় নিয়ন্ত্রণ, গরু-ছাগলের মরণব্যাধি প্রতিরোধ পদ্ধতিসহ আরও বেশকিছু গবেষণা মানুষের উপকারে এসেছে। এসব গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক নানা নামকরা প্রকাশনা সংস্থায়। এছাড়া কাপ্তাই লেকের হুমকির সম্মুখীন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের প্রথম ভ্রাম্যমাণ গবেষণা তরি। বর্তমানের এই জাহাজের মাধ্যমে লেকের সার্বিক বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। লেকের মাছ কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি সংরক্ষণেও নেয়া হবে নানা পদক্ষেপ। সামুদ্রিক গবেষণায় কার্যকরী কৌশল প্রয়োগ এবং সাগরতলের সম্পদ আহরণ, সংরক্ষণ ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে কপবাজারে স্থাপন করা হয়েছে 'কোস্টাল বায়োডাইভারসিটি, মেরিন ফিশারিজ অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চ সেন্টার।

মন্তব্য করুন