গুটিসুটি মেরে লঞ্চঘাটে শুয়ে ছিলেন জয়নাব বিবি। হঠাৎ কোথা থেকে এক যুবকের আগমন। জয়নাবের মাথার কাছে একটি প্যাকেট রেখে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি উঠলেন। প্যাকেট খুলে খেতে শুরু করলেন। দর্শক হিসেবে সব দেখছিলাম। পরে জানতে চাইলাম আপনাকে কে খাবার দিল? 'বাজান, তা তো জানি না। প্রায়ই খাবার দিয়া যায়। সব মজার খাওন।' জয়নাবের চোখের কোণ চিক চিক করছিল। এভাবেই কিছু যুবক ২০১২ সাল থেকে অসহায়, বৃদ্ধ, দুস্থদের হাতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন।

তারা কয়েকজন বন্ধু একসঙ্গে আড্ডা দিতেন। আড্ডার জায়গাটা ছিল একটি বস্তির কাছে। বস্তিবাসীর যাতায়াত, অভাব-অনটন চোখে পড়ত। ছেলেগুলোর খুব মায়া হতো। ইশ যদি কিছু করতে পারতাম ওদের জন্য। এমনটাই ভাবতেন। তাদের অনেকেই ছাত্র। কেউ কেউ টুকটাক ছবি আঁকেন। কতই-বা আয়। রাফাত নুর একদিন বলেই বসলেন, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়। নেবুলা মোর্শেদ, সাকিল, লাবিব, রুদ্র, জিয়া, সুমন, তামিম, মানিক ওই দিন যারা ছিল সবাই সম্মতি দিলেন।

এটা ২০১২ সালের ঘটনা। গরিব-দুস্থদের অনেককেই খাওয়ান। কিন্তু এই কার্যক্রম একটুখানি ব্যতিক্রম। তারা নিজেরা ছবি আঁকেন। সেই ছবি বিক্রি হয়। টাকা দিয়ে গরিব, দুস্থ, অসহায়দের মুখে খাবার তুলে দেন। রান্না করা খাবার, রান্না ছাড়া খাবারও বিতরণ করেন। খাবার হিসেবে থাকে ডিম-আলুর ঝোল ভাত, পোলাও মাংস, খিচুড়ি মাংস, মাছ-ভাত। শুকনো খাবারের মধ্যে রয়েছে শুকনো চাল, তেল, লবণ, আলু, ডিম ইত্যাদি।

বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে সংগঠিত করার কাজ খুব কঠিন। সে জন্য তারা 'ছবিরহাট' নামে একটি সংস্থার ব্যানারে সংগঠিত হয়। শুধু সুবিধাবঞ্চিতদের খাবার নয়। ছবিরহাট সুবিধাবঞ্চিতদের কাছে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ, গ্রামের দরিদ্র নারীদের কুটির শিল্প ও হাতের কাজ, দুর্যোগ আক্রান্তদের ত্রাণ সুবিধা প্রদান করে থাকে। খাবারের ক্ষুধা মেটায়। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কিছু বই, খাতা, কলম, স্কুল ব্যাগের প্রয়োজন তো থাকেই। ছবির হাটের স্বেচ্ছাসেবকরা বই, খাতা, স্কুলব্যাগও কিনে দেন। সব কার্যক্রমই স্বেচ্ছাশ্রমে হয়। সারাদেশে ৩২৭ জন স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন। এক টাকার খাবার প্রজেক্টে রয়েছেন ১২৩ জন স্বেচ্ছাসেবক। 'কোনোরকম চাঁদা সংগ্রহ নয়। কেউ চাঁদা দিতে চাইলে আমরা তাকে নিরুৎসাহিত করি। উদ্বুদ্ধ করি যেন খাবার কিনে সুবিধাবঞ্চিতদের দেয়। সে জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম, জনবল, রান্না করা খাবার বিতরণে সহযোগিতা করি। কীভাবে কী করতে হয়। পুরো বিষয়টা তাকে দেখিয়ে দেওয়া হয়। যাতে পরে সে নিজেই কাজ করতে পারে' বললেন রাফাত নুর। এক টাকায় কিছু হয় না। অন্যরা ফ্রি খাওয়ায়। তাহলে এক টাকা নেওয়ার কারণ কী? রাফাত নুর বললেন, 'এক টাকা রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেন ব্যাপারটিকে ভিক্ষার চোখে কেউ না দেখে। যারা খাচ্ছেন অর্থনৈতিকভাবে তারা দুর্বল। কিন্তু তারা আমাদের কাছে সম্মানিত। উপার্জন আয়ের উৎস হোক সেটাই আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। এসব কারণেই এক টাকা রাখা।'

ছবির হাটের খাবার বিতরণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটাই বললেন রাফাত নুর। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্পটের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে আমাদের সদস্যরা পর্যবেক্ষণ করেন। তালিকাভুক্ত করে প্রয়োজন অনুসারে খাবার দেওয়া হয়। এভাবে লক্ষাধিক প্যাকেট খাবার দেওয়া হয়েছে। রাফাতের কাছ থেকে জানা গেল, বয়সের ভারে উপার্জনে অক্ষম, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, সুবিধাবঞ্চিত শিশু তাদের তালিকায় অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। ঢাকার বাইরে রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠি, রংপুর, ফরিদপুর, কুড়িগ্রাম, পাবনা ও নারায়ণগঞ্জে এক টাকার খাবার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মাঝে মধ্যেই অর্থ সংকটে পড়তে হয়। কারণ হলো ছবির বিক্রি তো সবসময় সমান হয় না। রাফাত বললেন, আমরা আমাদের উপার্জনের ভিত্তি আরও মজবুত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। করুণা কিংবা দয়া নয়। শিল্পের গুণগতমান অক্ষুণ্ণ রেখে আমরা কাজ করি। উপার্জনক্ষম প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে বেকার যুবক আয়ের পথ খুঁজে পাবে। সেই আয়ের খানিকটা অংশ অসহায়, দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করবে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যেন তারা উপার্জনক্ষম হয়ে উঠতে পারেন। এসবই ছবির হাটের উদ্যমী পরোপকারী তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন।

মন্তব্য করুন