বৈশাখের এক শনিবার রাত ৯টায় ঝড়ের দাপট কমে এলে খায়ের শহরতলির কাঁচাবাজার থেকে বাড়িতে ফিরে মাংসের থলেটা বিরক্তি সহকারে ফেলে সন্দেহ আর রোষানল ভরা দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল। খায়েরের ভেজা শরীরে বৃষ্টির জল যত না স্পষ্ট তার চেয়েও বেশি স্পষ্ট চোখে জেগে ওঠা রোষানল। যে মেয়েটাকে বুকে নিলেই রাতের আঁধার মোহনীয় হয়, তার রক্তে জেগে ওঠে প্রবল আবেগ আর আগুন, সেই নারীই কি না তার সাথে প্রতারণা করল? তার সেই স্ত্রীর শরীরটা অন্য কোনো পুরুষের চেনা_ ভাবতে গিয়ে খায়েরের মাথার ভেতর কেমন দপ দপ করে জ্বালা করে! স্বামীর ক্ষোভ মেশানো দৃষ্টি নাহলা নীনাকে বিরক্ত করে তুলল। কালবৈশাখীর তুমুল ঝড়ে ঘরে বৃষ্টির জল ঢুকে গেছে। আর আঙিনায় উড়ে এসে জুড়েছে গাছের ভাঙা ডাল। কাদা-জল গায়ে মেখে রাতের রান্না আর ঘর-দোর পরিষ্কার করে নীনা মাত্র গোসল সেরে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। খায়েরের অমন দৃষ্টিতে বিরক্ত হয়ে সে বলল,
ওমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন? ঝড়টা মনে হয় আমার দোষে হলো?
তোমার পিঠের মাঝখানে একটা কাটা দাগ আছে_ এই তথ্য অ্যারিয়েন জানে কীভাবে?
৯ বছর পর প্রথম কারো মুখে 'অ্যারিয়েন' শব্দটা শুনে চমকে উঠল নীনা। খায়েরের মুখে 'অ্যারিয়েন' নামটা এমন করে উচ্চারিত হলো, যেন এইমাত্র সে তার সাথে কথা বলে এসেছে। ঝড়ে দিক্ভ্রান্ত আর উন্মত্ত সাগরের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের মতো তার হৃৎপিণ্ডের সব অলিন্দে রক্তকণা উন্মত্ত হয়ে উঠল। কালবৈশাখীর তা বের চেয়েও বড় এক ঝড় যেন তার ভেতরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলছে। নীনার হতভম্ব মুখ আর বিস্মিত চোখে চোখ রেখে খায়ের প্রশ্ন করল,
তোমার চেয়েও চার বছরের কম বয়সী ছেলের সাথে লুকিয়ে প্রেম করতে লজ্জা করে না তোমার?
অ্যারিয়েন যখন বেঁচে ছিল তখন নীনা তার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। নীনা কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। বসন্তের সেই রাতে হৃদয়ছেঁড়া কষ্টগুলো তাকে আজ আবার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। সে ফিরে গেল সেই রাতে, যে রাতে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে সে অ্যারিয়েনের কাছে গিয়েছিল। যে রাতে অ্যারিয়েনের মাথা থেকে প্রবাহিত গলগল রক্ত ভিজিয়ে দিয়েছিল তার বুকের প্রান্তর। মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া অ্যারিয়েনকে মুখোশ পরিহিত তিন যুবক যখন তার কোল থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে তাকে নির্মমভাবে খুন করেছিল। শোক সামলে ওঠার পর, তার বিয়ের পর অনেকবার সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে সে শুধু ভোর রাতে তার কবরে গোলাপ ফুল রেখে আসত। কণ্ঠের নিচে বিউটি বোনের অসম্ভব ওঠানামকে নিয়ন্ত্রণ করে নীনা শুধু বলতে পারল,
তুমি...? অ্যারিয়েনকে...
আর কিছু বলতে পারল না নীনা। সে ডুবে যাচ্ছে ৯ বছর আগের বাতাসে শনশন বসন্তের আমেজ আর আমের মুকুলের গন্ধ-ভাসা এক সন্ধ্যায়। আনুভা আর নেহা দুই বান্ধবী এবং তার সহপাঠী আফফানের সহযোগিতায় বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে সে পালিয়ে গিয়েছিল অ্যারিয়েনের কাছে। তার পর অ্যারিয়েনকে বাসার বাইরের দিকে মুখ করা লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করতে বলে দোকানের সাথে লাগোয়া ঘরটায় ঢুকে বিয়ের সাজে সাজা নীনা শরীরের শাড়ি-বল্গাউজ খুলতে খুলতে অ্যারিয়েনকে ডাকল,
এদিকে একটু এসো, প্লিজ। চোখ বন্ধ করে এসো।
বিদ্যুৎ এই সব গ্রামগঞ্জের শহরতলিতে রাতে প্রায়ই অধরা থেকে যায়। ভেতরে ঢুকে অ্যারিয়েন দেখল, ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে নীনা। তার শরীরে কাপড় বলতে শুধু একটা পেটিকোট। পেছনে শক্ত করে বাঁধা ব্রেশিয়ারটার হুক খুলতে মরিয়া নীনা বলল,
এটা খুলে দাও। তাড়াতাড়ি কর। আমি পালিয়েছি_ তা টের পাওয়ার আগেই আমরা এখান থেকে পালাব।
লজ্জা পেয়ে অ্যারিয়েন সত্যিই চোখ বন্ধ করল। কিন্তু তার বান্ধবীর দল বাসর রাতে বর যেন সহজেই ব্রেশিয়ারটা খুলতে না পারে তার জন্য বস্তুটার হুকগুলো শক্ত করে সেঁটে দিয়েছে। না ছেঁড়া পর্যন্ত তা খোলা কঠিন কাজ বলেই মনে হচ্ছে। চোখ বন্ধ রেখেই অ্যারিয়েন বলল,
এটা থাক না... নাহলা আর আনুভা নীনার ব্যাগটা রেখে বাইরে একটা ট্যাক্সি বসিয়ে রেখে চলে গেছে। তাদের টেনে আনা ব্যাগটা থেকে ওড়না বের করে কাপড়টা বুকের সামনে নীনা এমন অবহেলায় ধরল যেন ওটা না ধরলেও অশুদ্ধ কিছুই হয় না। বলল,
না, বিয়ের জন্য দেওয়া কিছুই আমার শরীরে থাকবে না। খোলো... চোখ খুলেই ওটা খোলো।
কিন্তু চোখ খোলার পর অ্যারিয়েন অবাক হয়ে দেখল, একেবারে প্যারাস্যুট সুতা দিয়ে বস্তুটা ভালোমতো সেলাই করা। তাকে এই তথ্য জানাতেই নীনা বলল,
তাই তো বলি, বাসন্তী অতক্ষণ ধরে ওখানে আসলে কী কারুকাজ করছিল...
কী অদ্ভুত খেয়াল! পৃথিবীর আর কোনো প্রান্তরে এমন ঘটনা ঘটেছে কি-না যে, বিয়েটা মেনে নিতে পারছে না বলে কোনো তরুণী বরপক্ষের সবকিছুকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য এভাবে মরিয়া হয়ে ওঠে? খেয়ালের ঘোরেই হয়তো মানুষ নির্ধারণ করে ফেলে তাদের গন্তব্য। কাজটা পরে করা গেলেও নীনা এখনই তা নিয়ে জেদ করছে, নিজেও কী এক আনন্দঘোরে ডুবে যাওয়ায় এ নিয়ে অ্যারিয়েন আর কোনো প্রশ্ন করছে না। কিন্তু অনেক চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বাধ্য হয়ে অ্যারিয়েনকে চোখ খুলতেই হলো। মোমবাতির আলো যেন নীনার বাদামি ত্বকের ভেতর থেকে তার গোলাপি আভাকে বিচ্ছুরিত করছে। ছটফটে আর প্রাণবন্ত নীনাকে চোখ খুলে এভাবে প্রথম দেখে অ্যারিয়েনের যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না_ পৃথিবীটা এত রহস্যময়! পৃথিবীর সব উচ্ছলতা, সতেজতা আর বসন্তের আম-মুকুলের ঘ্রাণে মাতাল সবুজের প্রাণময়তার আবেশ মেশানো নীনার যৌবনে জাগা চঞ্চলতায় ভরা শরীরটা স্পর্শ করতে লজ্জার চেয়ে এখন অ্যারিয়েনের ভয় করছে। যেন হাতটা দিয়ে নীনাকে ছুঁয়ে দিলেই সে বাতাসে মিলিয়ে যাবে। তার হাত মোমবাতির তিরতির কাঁপনরত আলোর মতো কাঁপছিল। এবার নীনার ধমক খেয়ে সে ব্রেশিয়ারে হাত রাখার আগে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্যই পরীটার পিঠ আলতো স্পর্শ করল। না, এ সত্যিই তার নীনা। নীনা নাহলা! অ্যারিয়েন লাল টকটকে ব্রেশিয়ারের হুক আপ্রাণ টানাটানি করল তবু কাজ হলো না।
ওটা ছিঁড়ে ফেলো...
ঠিক সে সময় মোমবাতির আলো কেঁপে গেল। যেন বাইরে থেকে কোনো অশুভ সংকেত বাতাসের কম্পাঙ্ককে অস্থির করে তুলল। নীলার মনে হলো, বাইরে থেকে কিসের শব্দ এগিয়ে আসছে! সে বিরক্ত হয়ে বলল,
উফ্! এত সময় নিচ্ছ কেন? তাড়াতাড়ি কর, প্লিজ। বসন্তপুর আমার বান্ধবীর ফুপুর বাসায় আগে যাব। তারপর সেখান থেকে...
নীনার খোঁপাটা ঠিক সেই মুহূর্তে খুলে গেল। ঘন কালো চুলের রাজ্যে ডুবে গিয়েও তার পিঠের ত্বক মোমবাতির আলোকে হয়তো তার রক্তাভা ধার দেওয়ার জন্যই কেশগুচ্ছের ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। নীনার এই চুলগুলোর মাঝে যেন লুকিয়ে আছে মেঘনিনাদিত একটা ঘনঘোর আষাঢ়দুপুরে উষ্ণতা। তার ত্বকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক মায়াবী জোছনার প্রান্তর যেন তাকে হাতছানি দিয়ে অনাগত যে জীবন, তার ঘ্রাণের মাঝে অ্যারিয়েনকে তলিয়ে নিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ফলকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে এই মফস্বল শহরে সে থিতু হওয়ার স্বপ্ন দেখত হয়তো এমন একটা দিনের জন্য। নীনাকে এভাবে একবার কাছ থেকে দেখলে কত জন্মের সব পাওয়া পূরণ হয়ে যায়! স্রষ্টার প্রতি মনে মনে অ্যারিয়েন কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল।
প্রবহমান মহাসড়ক থেকে একটু ভেতরে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নদীর ওপর কয়েকটা আম-জামগাছের ছায়াতলে তাদের বাড়ির সাথে একটা লাইব্রেরি। সে মনে মনে বাবার শিক্ষকতা পেশাকে নিজের পেশা হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ঠিক এই সময়েই। তার পর বর্ষা, বসন্ত আর সন্ধ্যা-মায়ার কুহেলিকায় জড়ানো জীবনের সব পাতা সে নীনাকে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখবে। তাকে বুকের কাছে নিয়ে একটা প্রিয় বইয়ের পাতা থেকে সে তার প্রিয় নারীর কানে ফিসফিস করে শোনাবে কোনো গল্প। গল্পের পরিণতি জেনে ভিজে উঠবে দু'জনের চোখ; আর্দ্র হবে হৃদয়। জীবনে প্রথম দেখা নীনার অপার সৌন্দর্যের এসব রহস্য ডুবে গিয়ে বিচিত্র অনুভূতি আর অসম্ভব সব ভাবনার দর্শনে আসল কাজটা করতে অ্যারিয়েনের দেরি হয়ে যাচ্ছিল। নীনার তাড়া খেয়ে সে এবার পাশের ঘর থেকে একটা চাকু আনল। হুকটা কেটে ফেলার আগে বলল,
ভয় পেয়ো না।
এখন মরে যেতেও আমার ভয় নেই...
অ্যারিয়েন হুকের নিচে মাত্র চাকুটা নিয়েছে, সাথে সাথে দরজায় দুমদুম শব্দ শুরু হলো। চোখের পলকে নীনা উল্টো ঘুরল। সাথে সাথে মোমের সি্নগ্ধ আলোর সাথে জোছনা হয়ে খেলা করা নীনার ত্বকের ভেতর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়াল।
মুখোশ পরা লোকগুলো অ্যারিয়েনের মাথাটা প্রায় থ্যাঁতলা করে চলে গেলে বাকরুদ্ধ নীনার কোলে মাথা রেখে অ্যারিয়েন দেখল, বর্ণময় অসংখ্য প্রজাপতি তাকে আর নীনাকে নিয়ে গোলাপের সুবাসে ভরপুর টকটকে লাল কোনো বর্ণের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছে। ঘরের ভেতর চিরচেনা সেই গন্ধে বসন্তের শনশন হাওয়া প্রকৃতির সব ফুল থেকে, মুকুল থেকে নীনার ত্বকের ঘ্রাণ এনে ভরিয়ে তুলছে নদীর কিনার পর্যন্ত।
২.
নীনার চোখের নিকষ কালো মণির অমন নীল দৃষ্টির চাউনিতে স্রষ্টা কী অমন রূপ মেখে দিয়েছিলেন যে, তার বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে বসন্ত বাতাসের মতো চঞ্চল হয়ে উঠল এই শহরতলির তরুণদের মন। কিন্তু ঝরণাধারার মতো দস্যি মেয়েটার গতিময় চলা, ঋজু-নির্মেদ শরীরের চপলতায় কোনো কিছুকেই থোড়াই কেয়ার করা ভাবটা কেন যে অ্যারিয়েনের চোখে চোখ রাখলেই থেমে যায়, থেমে গিয়ে সে চমকে যায়; তা সে জানে না। ছেলেটার অধ্যাপক বাবা গ্রিক কবির নামে এই নামটা রেখেই যত বিপত্তি বাধিয়েছেন বলে নীনার মনে হয়। তার শান্ত আর গভীর চোখের ভাষায় কবিতা নয়, যেন কবিতাময় গল্পের রহস্য খেলা করে। তার সাথে বই আদান-প্রদান এবং তা পাঠের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে তার চোখের ভাষার সেই বিপত্তির মাঝে আটকা পড়ে নীনা কখন মেধাবী ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলল! অ্যারিয়েন যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঢাকায় যাচ্ছে, নীনা তখন বাড়ির পেছনে নদীর দিকটা দিয়ে তার ঘরে ঢুকে বলল,
আমি নদীর পাড়ে বসে আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকব।
তাহলে তো আমাকে ভুলে যাবে!
কেন?
গ্রিক দেবতা নার্সিসাসের মতো নদীর জলে নিজের রূপ দেখে তুমি এত মুগ্ধ হয়ে থাকবে যে, আমার কথা আর মনে পড়বে না। তবে, আমার সব সময় মনে হবে, নদীর ধারে নারগিস নয়, নীনা নামের এক ফুল আমার জন্য অপেক্ষা করছে...
নীনা তার কথায় মুখ টিপে হাসল। ওভাবে হাসলেই মেয়েটার বাম গালে কেমন অদ্ভুত টোল ছোট্ট এক ঢেউয়ের মতো জাগতে গিয়েও বিলীন হয়ে যায়। সে বলল,
পানিতে সে আপন ছায়ার ভেতর নিজেকে নয়, অ্যারিয়েনকে খুঁজছে। সেদিনই প্রথম তারা একে অন্যকে 'তুমি' সম্বোধন করল। চলে যাওয়ার আগে একটা গোলাপ নীনার হাতে দিয়ে অ্যারিয়েন বলল,
তোমার পাঠ-পঠন আর মনন ঠিক তোমার মতো... খুব ধারালো ... সুন্দর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হওয়ার কিছুদিন আগেই তাদের এই ভালোবাসার খবর নীনাই তার বাবা-মাকে জানালে তিনি অ্যারিয়েনের বাবাকে একজন 'নাস্তিক' আখ্যা দিয়ে তা শুধু প্রত্যাখ্যানই করলেন না; মেয়ের এমন ধৃষ্টতায় রাগান্বিত হয়ে তাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। নীনার মায়েরও অ্যারিয়েনকে পছন্দ বলে তিনি বললেন,
ওরা মুসলমান। অ্যারিয়েন পড়াশোনায় কত ভালো! ওর মতো সুদর্শন ছেলে এই শহরে দেখাতে পারবে?
চুপ। মেয়ের মতো শোনায় ওসব নাস্তিক নাম। 'অ্যারিয়েন' নামের কোনো ছেলের শ্বশুর হওয়ার আগে আমি আমার মেয়েকে কেটে ফেলব। তার পরই তিনি নীনার বিয়ে নিয়ে দামামা তুললেন। নীনা অ্যারিয়েনকে বাড়ি ফিরে আসতে বলল। দস্যি মেয়েটা জানে, এখন তার করণীয় কী...
৩.
অ্যারিয়েন খুন হওয়ার ছয় মাসের মাথায় লন্ডনের বিবিএর পাট চুকিয়ে খায়ের দেশে ফিরল। নীনার সাথে বিয়ের পর একদিন সে রজনীগন্ধার সাথে গোলাপ মিশিয়ে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে রাতে ঘরে ফিরে তার হাতে দিয়ে বলল,
তুমি এই গোলাপের চেয়েও সুন্দর!
কিন্তু পরদিন ঘুম ভেঙে খায়ের খেয়াল করল, ফুলের তোড়ায় রজনীগন্ধা থাকলেও একটা গোলাপও নেই। সে নীনাকে কোনো প্রশ্ন করল না। জ্যোতিষ সম্রাট তার হাত দেখে তাকে বলেছিল,
মেয়েটাকে যখন এতই চাই তোমার, তাহলে তাক ধরে রাখার জন্যি মদ্যে মদ্যে একটা রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুলের তোড়া উপহার দিবা। তবে, একটা কাজ ভুলেও করবা না। তা হলো, রক্তবর্ণের সাথে যায় এমন কোনো রঙ নিয়ে তাকে কোনোদিন প্রশ্ন করবা না।
গোলাপগুলো অ্যারিয়েনের রক্তের মতো! তবু খায়েরকে ফুলগুলো কিনতে হয়। তার গুরু জ্যোতিষীর পরামর্শে যেহেতু সে নীনাকে পেয়েছে, তাই সে তার পরামর্শেই নীনাকে ধরে রাখতে চায়। সুতরাং এ নিয়ে সে নীনাকে কোনো প্রশ্ন না করে, আরো কয়েক দিন একইভাবে ফুলের তোড়া এনে দিয়ে পুনরায় খায়ের অবাক হয়ে খেয়াল করল, একইভাবে রজনীগন্ধা ছাড়া শুধু গোলাপগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে। এর পর ফাল্গুন মাসে দ্বিতীয় এক বৃহস্পতিবার বিকেলে আরও একটা ফুলের তোড়া দিয়ে সে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমের ভান ধরে সারারাত জেগে থাকল। ভোর রাতে অন্ধকারের মধ্যেই খায়ের দেখল, নীনার মতো এক নারীমূর্তি রজনীগন্ধার ভেতর থেকে সন্তর্পণে গোলাপগুলো নিয়ে অন্ধকারেই মিলিয়ে গেল। বিছানায় হাত দিয়ে সে পরখ করল, নীনা তার পাশে নেই। সে গোপনে ছায়াটাকে অনুসরণ করল। সেই নারী-ছায়া বাসা থেকে বের হয়ে নদীর ধার ধরে ধরে অ্যারিয়েনের কবরের কাছে গিয়ে থামল। ফুলগুলো তার কবরের ওপর রেখে যা বলল, খায়ের তার কিছুই শুনল না,
অ্যারিয়েন! জ্যোতিষ সম্রাট, খোদার কসম খেয়ে আমাকে কথা দিয়েছে_ এই লাল গোলাপগুলোই একদিন সেই মুখোশ পরা শয়তানদের চিহ্নিত করবে। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন তাদের খুঁজব। তোমাকে অনেক ভালোবাসি...
প্রাচীন এক গাছের আড়াল নিয়ে বসে থাকলেও খায়েরের মনে হলো, সে গাছের পাতার ভেতর এক ডাল ধরে ঝুলে আছে। সে খুব সাবধানে গাছ থেকে নেমে এলো। তারপর নদীর পাড়ে অ্যারিয়েনের কবরটায় চোখ রাখল। কী আশ্চর্য, ওখানে কেউ নেই! সেই নারীমূর্তি কখন এবং কোথায় উধাও হয়ে গেল সে কিছুই বুঝল না। ভোরের আলো প্রায় ফুটে উঠল। বাসায় এসে খায়ের দেখল, নীনা আরাম করে ঘুমাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে তার মাথার মধ্যে কী এক চক্কর দিল; সে সেই ভোরেই সিদ্ধান্ত নিল, অধ্যাপক সাহেবের লাইব্রেরিতে বসে ব্যাপারটার সুরাহা করবে। অধ্যাপকের সুন্দর ছেলেটা কেন একটু পর পর লাইব্রেরি ছেড়ে ওষুধ আর মলম নিয়ে ভেতরে যায়? আর যখন সে ফিরে আসে তার ডান হাতের অনামিকায় লেগে থাকে একটু রক্ত!
সেদিন থেকেই সে বাজার আর আড্ডার কথা বলে শহরতলির দোকানপাট এলাকায় যাওয়া আরম্ভ করেছিল এবং অ্যারিয়েনকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। ৯ বছর আগে যেমন ছিল তার চেহারা, গড়ন, ওজন_ তার কিছুই বদলায়নি। এমনকি অ্যারিয়েনের চুলগুলো কখনোই সে আর ছোট-বড় হতে দেখেনি।
জ্যোতিষ সম্রাট এ এলাকায় তাকে একদিন দেখে এদিকটায় ঘোরাফেরা করতে বারণ করলেও অ্যারিয়েনের লাইব্রেরির বইগুলোর ভেতর লুকিয়ে থাকা হাজার বছরের গন্ধের সাথে রক্তভেজা মাটির গন্ধটুকুতে যেন নীনার শরীর, তার চুল-ত্বকের ঘ্রাণ মেশানো রহস্যময় এই তথ্যটুকু জানার নেশা থেকে সে কিছুতেই নিজেকে মুক্তি দিতে পারছে না। তা ছাড়া ছেলেটা একটু পরপর ঘরের ভেতর গিয়ে তার প্রিয় নারীকে কী শুশ্রূষা দিয়ে আসে, একটা অসুস্থ মেয়েকে ৯ বছর ধরে এত সেবা করতে গিয়ে, তার আঙুলকে রক্তে ভিজিয়েও ছেলেটা কীভাবে তার মুখের ভেতর অমন সি্নগ্ধ হাসি ধরে রাখে; তা খায়েরের খুব জানতে ইচ্ছা করে। আজ সে সব জানবেই।
বাজারের উত্তরের গলিটা নির্জন হয়ে গেলে তার শেষ মাথায় বাবলুর চায়ের দোকানে গিয়ে সে এক কাপ চা খেয়ে নেয়। তারপর মৃদু পায়ে হেঁটে হেঁটে প্রধান সড়ক ডানে ফেলে নদীর দিকের বাড়িটার সামনে লাইব্রেরিতে যায়। অ্যারিয়েন তাকে দেখে মিষ্টি করে হাসে। কী গভীর মনোযোগে আজও ছেলেটা বইয়ের পাতায় মগ্ন হয়ে আছে। কেউ কি নিজেকে এমন মুগ্ধ হয়ে দেখে? আজ প্রথম খায়েরের মনে হলো, বইয়ের পাতায় নয়; অ্যারিয়েন যেন নদীর দিকে তাকিয়ে তার জলে নিজের ছায়া দেখে মিটি মিটি হাসছে। ওই যে, তার শিক্ষকের বাসায় লজিং থেকে পড়ার সময় তার ছেলেটাকে সুন্দর একটা মেয়ে বলেছিল, তার জন্য মেয়েটা নদীর জলের দিকে তাকিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে! ঘরের জানালার পর্দা ফাঁক করে সেই কথাটা তো সে স্পষ্টই শুনেছিল।
তার মনে পড়ে, তার এক শিক্ষক ক্লাসে গ্রিক দেবতা নার্সিসাসের গল্প শুনিয়েছিলেন। এই ছেলেটা যেন তারই প্রতিমূর্তি। আজ তার হঠাৎ এ-ও মনে পড়ল, সেই গ্রিক সভ্যতা আর সাহিত্য নিয়ে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী তার সেই শিক্ষক তার সন্তানের নামও রেখেছিলেন এক গ্রিক কবির নামে। আর তার এ-ও মনে পড়ল, সেই শিক্ষকের বাসায় লজিং থেকেই সে পড়াশোনা করে বড় হয়ে উঠেছিল। অনেক চেষ্টা করেও সে তার শিক্ষকের ছেলেটার নাম মনে করতে পারে না। দিন দিন অকৃতজ্ঞ হয়ে ওঠা বাঙালির মনস্তত্ত্বের সূত্রে ওটা একটা ভুলে যাওয়া চ্যাপ্টার হলেও, খায়ের এটা বোঝে, অ্যারিয়েন যেন তার সেই শিক্ষকের সন্তানের চোখ-মুখ আর বয়স চুরি করে এখানে বসে থাকে।
তার চেয়েও বয়সে ঠিক ৯ বছরের ছোট ছেলেটা কি পড়ার ছলে আসলে গোপনে বইয়ের পৃষ্ঠায় কোনো মেয়ের ছবি দেখে? মেয়েটা কে? না, আজও তার অনামিকার আঙুলের ডগায় রক্ত লেগে আছে। সে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ছেলেটার সেই পুরাতন রোগ; মলম নিয়ে ভেতরের ঘরে যাওয়ার তাড়া,
ওর পিঠের ওখান থেকে রক্ত ঝরছে। তুমি একটু বসো। আমি মলম লাগিয়েই ফিরে আসছি।
ছেলেটা পাগল নিঃসন্দেহে। খায়েরের মনে হয়, তার চোখের ভেতর একটা ঈগল এইমাত্র মণি বসিয়ে দিয়ে গেল। তার চোখের সেই মণিতে ত্রূক্রর সন্দেহ। কয়েক বছর ধরে একজন মেয়ের পিঠ থেকে রক্ত ঝরলে সে বাঁচে কীভাবে? ডাক্তারের কাছে সে তাকে নেয় না কেন? না, আজ সে অ্যারিয়েনকে ছাড়বে না। ছেলেটা ভেতর থেকে লাইব্রেরিতে ফিরলে সে প্রশ্ন করল,
এত বছর ধরে যে মেয়েটাকে যত্ন করছ, তার নাম কী?
অ্যারিয়েনের মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেল। হাত থেকে বইটা সে ফেলে দিল। খায়ের দেখল, ছেলেটার চোখ বাঘের চোখের মতো হিংস্র হয়ে গেছে। শক্ত চোয়ালের ভেতর তার মাংসাশি প্রাণীর মতো দাঁতগুলো যেন এক একটা চকচকে ধারালো তরবারি। খায়েরের বুকের ভেতর কাঁপনটুকু আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে তা বড় বড় গাছের মাথায় গিয়ে তা ব শুরু করল। আর তখনই শুরু হলো বৈশাখের পট্রমত্ত ঝড়। কিন্তু ঝড়টা এলো অ্যারিয়েনের চোখের ভেতরের উত্তাল ঢেউয়ের তরঙ্গকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে। খায়ের অ্যারিয়েনের চোখের মণির মধ্যে এক দৃশ্য দেখে এবার ভড়কে গেল। যেন সে আয়নার মধ্যে দৃশ্যটা দেখছে। সে দেখল, গাঢ় অন্ধকারের প্রচ ঝড়ের মধ্যে একটা নারীমূর্তি দৌড়ে যাচ্ছে অ্যারিয়েনের কবরের দিকে।
তীব্র বিজলীর ঝলকানিতে নদীর পাড় আর আম-মুকুলের গন্ধে মেতে থাকা সবুজ এক চরাচর জেগে উঠল। নারীটার শরীর থেকে শাড়ি খসে খসে তার লাল পাড় দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে শত শত মিটার নদীর কিনার, তার বালুতট। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সেই অনবরত বিজলী যেন একটা দৃশ্যকে স্পষ্ট করার জন্য মরিয়া। নারীমূর্তিটার হাতে ধরা সেই গোলাপগুলোতে কি তাই ঘন ঘন এত বজ্রপাত হচ্ছে? খায়ের জানত, বজ্রপাতে গাছও পুড়ে যায়। কিন্তু, নারীটার তাতে কিছু না হলেও প্রতিটি বজ্রপাতে তার হাতের ফুলগুলো থেকে রক্তকণা ছলকে উঠছে। তার সাথে প্রতিটি বজ্রপাত মেয়েটার কান্নাকে বলকে বলকে তুলছে। সে খুব মনোযোগের সাথে নারীটাকে নিরীক্ষণের ভঙ্গিতে অ্যারিয়েনের চোখের ভেতরে, আরও ভেতরে তাকানোর ইচ্ছায় তার মুখের দিকে ঝুঁকে গেল। কী আশ্চর্য! খায়েরের মুখ থেকে তৎক্ষণাৎ অস্টম্ফুটকণ্ঠে উচ্চারিত হলো,
নীনা! নাহলা? এবার অ্যারিয়েনের কণ্ঠ সে স্পষ্টই শুনতে পেল,
হ্যাঁ, সে আমার নীনা। তার পিঠ থেকে ঝরা রক্তকে আমি পাহারা দিই। আর কোথাও নয়, নীনা বাস করে রক্তগোলাপের ঘ্রাণভেজা আমার এই ঘরে।
খায়ের দৌড়ে পালাতে গিয়েও আবার দ্রুত ঘুরল। কাঁচাবাজার থেকে সে গরুর মাংস কিনেছে। গরুর মাংস ভক্ষণের লোভ তার জাগতিক ইন্দ্রিয়কে নীনার প্রতি যতটা মনোযোগী করে, তা এই বজ্রপাতে গোলাপগুলোর ছলকে ওঠা রক্তের মতোই।
৪.
খায়ের ক্ষোভের সাথেই বলল,
হ্যাঁ, অ্যারিয়েন নিজের মুখে আজ আমাকে তা বলেছে। গোলাপ ফুল রহস্য আর তোমার পিঠ থেকে রক্ত ঝরার কাহিনীটা এখনই নিজের মুখে শুনে এলাম।
বাক্যটা শোনামাত্র নেতিয়ে পড়া নীনার শরীরটায় এই কালবৈশাখী যেন আর একটা বজ্রপাত করল। আকাশ-মেঘ, স্বর্গ-মর্ত্যকে বিদীর্ণ করা কর্কশ কড়াৎ-কড়াৎ উচ্চ নিনাদ গড়িয়ে চলল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তা গড়িয়ে চলল নীনার শরীরের নিম্নপ্রান্ত থেকে মাথায়। হৃদয় থেকে সব কোষ হয়ে স্নায়ুতন্ত্র পর্যন্ত তার শরীরের সব রক্ত এক সাথে ছলকে উঠল। ৯টা বছর ধরে একজন শত্রুর হাতে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপল তার দুই ঠোঁট। নীনার চোখে বজ্রের ধ্বনিতে যত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তত ভোল্টেজ তাকে যেন পুড়িয়ে ফেলল। ৯ বছর পর বিয়ের দিন পালিয়ে যাওয়ার সময় সাথে নেওয়া ব্যাগটার কথা তার আজ মনে পড়ল।
নীনার মনে পড়ল, সেদিন পালিয়ে যাওয়ার জন্য নেওয়া কাঁধে ঝোলানোর জার্নি-ব্যাগটার ভেতরের এক পকেটে সে লুকিয়ে রেখেছে সেই রক্তমাখা চাকু আর অ্যারিয়েনের হাতের স্পর্শ পাওয়া লাল ব্রেশিয়ারটা... সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে ৯টা বছর! ি

মন্তব্য করুন