দেশের লুপ্তপ্রায় সাংসারেক ধর্মের গল্প নিয়ে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র 'গিত্তাল মি আচ্ছিয়া'। আসমা বীথির তৈরি করা প্রামাণ্য চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন শতবর্ষী বৃদ্ধ জনিক নকরেক। ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলের মধুপুরের চুনিয়া গ্রামে চলচ্চিত্রটির প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। চলচ্চিত্রটি নিয়ে বিস্তারিত...

এ যেন এক প্রদোষের গল্প। এই গল্পটা প্রাকৃতজনের, প্রাকৃত সাংসারেকদের প্রদোষকালের। এই গল্পের চলচ্চিত্রভাষ্য দেখার পর মনে হলো, গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে জেগে উঠলাম বুঝি। বিপন্নবিস্ময়তাড়িত আমি জনিক নকরেকের পা ছেঁচড়ে হাঁটার দৃশ্যটা ভুলতে পারছি না এখনও। ঝরাপাতা মাড়িয়ে শালবন ধরে হাঁটছেন তিনি। অগ্নিপরীক্ষার অন্তে দাঁড়ানো এই মানুষটি যখন শেষ দৃশ্যে ক্যামেরার দিকে ঘোলাটে চোখ মেলে তাকালেন আমার মনে পড়ল কবীর সুমনের গান, 'উঠে দাঁড়ালেন অরুণ মিত্র'- 'উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায়/ পুরানো মাটিতে গাছের চারা/ সে উত্থান দেখে নেয় শুধু/ মহাজীবনের সঙ্গী যারা।'

'গিত্তাল মি আচ্ছিয়া'র পোস্টার

 জনিক নকরেক, যাকে আমরা আচ্চু বলে ডাকি, তিনি যখন ক্যামেরার দিকে তাকালেন, তখন আমি তাকালাম তার দিকে। আমি আচ্চুর পাশে বসেই দেখছিলাম প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি, 'গিত্তাল মি আচ্ছিয়া' নামে যে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের নির্মাতা কবি আসমা বীথি। বীথি ছিলেন আমার আর জনিক নকরেকের মাঝখানে। শুধু পরিচালনা নয়, বীথি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ, গবেষণা ও পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছেন। দেশে এর প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল চুনিয়ায়, গত ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার এই গ্রামটির সঙ্গে জনিক নকরেকের নাম একাকার হয়ে গেছে, যেমন হয়েছে, রফিক আজাদের কবিতা 'চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া'। কবিতায় যে চুনিয়াকে রফিক আজাদ বলেছেন, 'যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি', ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বীথি বারবার গিয়ে 'গিত্তাল মি আচ্ছিয়া'র জন্য তুলে এনেছেন সেই চুনিয়া, চুনিয়ার সমার্থক হয়ে ওঠা জনিক নকরেক এবং বাংলাদেশের শেষ সাংসারেকদের।

'গিত্তাল মি আচ্ছিয়া' একটা স্বাধীন চলচ্চিত্র। আচিক ভাষায় রাখা এই নামটির ইংরেজি করা হয়েছে 'AS THE GRAIN RISES ', যার বাংলা হবে 'নতুন ধানের জন্ম'। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র জনিক নকরেক, যার বয়স ১২০ বছর বলে দাবি করা হয়, মতান্তরে ১১৫ এবং তার কম যে নয় এটা নিশ্চিত। এই মানুষটিকে কেন্দ্রে রেখে লুপ্তপ্রায় একটি ধর্মের গল্প বলা হয়েছে, যা সাংসারেক ধর্ম নামে পরিচিত।


একদা মান্দিদের সবাই এই ধর্মের অনুসারী ছিল এবং এখন এই ধর্মানুসারীরা শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ধর্মান্তরের প্রক্রিয়াটা খুব বেশি দিনের নয়। ফিরিঙ্গিরা হানা দেওয়ার আগ পর্যন্ত সাংসারেকরা টিকে ছিল ভালোভাবেই। তাই বোধ হয় তথ্যচিত্রটি শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বিখ্যাত সেই গান 'উর তাং তাং/ ধনুকে জোর দেরে টান/ টানা বাবা টানা/ ফিরিঙ্গি দেয় হানা/' ব্যবহার করা হয়েছে এবং সাঁওতাল বিদ্রোহের ওপর তৈরি করা এই গানের ব্যবহার আমার কানে একটা বিচ্যুতি হয়ে বাজল। শুধু তাই নয়, দামা-আদুরির বাজনায়, শালবনের বাতাসে ভেসে আসা পাখির ডাক, বনের নির্জনতা ছাপিয়ে আচ্চু জনিকের লাঠির ঠকঠক যে আবহ তৈরি করেছিল, তা একটুখানির জন্য বিঘ্নিত হলো। অথচ অনায়াসে আদিবাসী শিল্পীদের গানের দল মাদলের গাওয়া পিরেন স্লান ব্যবহার করা যেত এখানে। মান্দিদের অন্য কোনো গান ব্যবহার করা হলেও মন্দ হতো না। পিরেন স্লান গানটির কথা মনে এলো মাদলের সদস্য আন্তনী রেমা তথ্যচিত্রে সাংসারেক বিশ্বাসের ব্যাখ্যা করছিলেন যখন, তখন মনে এলো গানটির চরণ 'এই বন যতদূর ঠিক ততদূর আমার বাড়ি/ এই মাটিতে পোতা আছে আমার নাড়ি।' সাংসারেক বিশ্বাসে নাড়ির সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো কিছুর মালিকানা হয় না। বনের গাছপালা, লতা-পাতা, পশুপাখির মালিকানা দাবিদার রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্রুপটাও টের পাওয়া যেত গানে, মধুপুরের বনটাও তখন আরও প্রতীকায়িত হতো হয়তো। সাংসারেক বিশ্বাস মতে, আমরা সবাই প্রাণের জন্মদাত্রী দেবী বাগবার সন্তান, মানুষ, পশু-পাখি, বনের যত পোকামাকড়, গাছপালা সবাই তার সন্তান হিসেবে নাড়ির সম্পর্কে সম্পর্কিত।

শেষ দৃশ্যে জনিক নকরেক

৩৬ মিনিটের এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে আরও কয়েকটি সাক্ষাৎকার ব্যবহূত হয়েছে। তথ্যকে প্রামাণ্য করার জন্য সাক্ষাৎকারের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এ সব সাক্ষাৎকারের একটি, সুজিত রুগার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জনিক নকরেকের কথোপকথন নিয়ে অতিকথন, রীতিমতন ছন্দপতন ঘটিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চুনিয়ায় গিয়েছিলেন, জনিক নকরেকের সঙ্গে তার দেখাও হয়েছিল, এই সবই ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু তাদের কথোপকথন ছিল কেমন? নিশ্চয়ই যেমনটা সুজিত রুগা বলছেন, তেমন নয়। আমার মনে হয়, সুজিত রুগার বক্তব্যের শেষাংশ একটু সম্পাদনা করা গেলে ভালো হবে।

এই সব সাক্ষাৎকার গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সব সাক্ষাৎকার ছেড়ে আমার কানে বাজছে, আচ্চুর স্বগতোক্তির মতো বলে যাওয়া, 'জমিদার আছিল। কাগজের ট্যাহার মধ্যে ছাপ দিয়া গেছে। এককালে আছিল একআনি জমিদার, দুইআনি তালুকদার। আমগোরা মান্দির মধ্যে আছিল না, এখনও নাই। নাই সোনা আর রুপাও। সব নিয়া গিয়া আজ কেবল কাগজে ছাপ মারা টাকা রাইখা গেছে ওরা।' আচ্চু বাংলা বলেন তার মতো করে, বাক্যগুলো এমনই, কিন্তু অর্থ অনেক গভীর, যে বাক্য বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীরে, 'নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে'।

আমরা বাঙালিরা যাকে দাদা বা নানা বলি, মান্দিদের আচিক ভাষায় তাকেই আচ্চু বলে ডাকা হয়। তবে জনিক নকরেক আমার কাছে যেমন আচ্চু, তেমনই আমার ভাগ্নিদের কাছেও। প্রথমবার চুনিয়া যাওয়ার সময় আমি ভেবেছিলাম, আচ্চু বুঝি জনিক নকরেকের ডাক নাম। আচ্চু আসলে একটা বিশ্বাসের ডাক নাম, যে বিশ্বাস শুধু মানুষের কথা বলে না, প্রকৃতির আরাধনা করে। প্রাণে প্রাণ মেলাবার কথা বলে। তাই তো আচ্চু জনিক বলেন, 'ধানের জোরে মানুষ, মানুষের জোরেই ধান।'

চলচ্চিত্রটির প্রথম প্রদর্শনীতে জনিক নকরেকের হাতে স্মারক তুলে দেওয়া হয়েছে

'গিত্তাল মি আচ্ছিয়া'র সিনেমাটোগ্রাফিতে বেশ বৈচিত্র্য আছে এবং দিনের পর দিন গভীর মগ্নতার সঙ্গে একটু একটু করে বীথি এই সিনেমার দৃশ্যসকল ধারণ করেছেন। তবে এগুলো সম্পাদনার জন্য অবশ্যই পংকজ চৌধুরী রনিরও প্রশংসা প্রাপ্য হয়। দৃশ্যের ভিজ্যুয়াল এফেক্ট তৈরিতে তেমন বাড়তি কারিগরি না করেই মুগ্ধ হওয়ার মতো কাজ করেছেন তিনি। সংগীতে মান্দি জনগোষ্ঠীর গান, নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র ও সুরের সঙ্গে বনের বাতাস, পাতার মর্মর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার তত্ত্বাবধান করেছেন কনক রাজবর। তিরেশ নকরেকের গানটিকে মন্ত্রপাঠের মতো করে ব্যবহার করা হয়েছে। নিছক প্রেমের গানটি ভিন্নমাত্রা পেয়েছে ব্যবহারের গুণে। প্রামাণ্যচিত্রে মান্দিদের ভাষা আচিক এবং বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। আচিক থেকে বাংলা করেছেন পরাগ রিছিল। বাংলা থেকে ইংরেজি মাহমুদ আলম সৈকত। শব্দ ধারণ করেছেন রনি জাবালি। ছবিটির কারিগরি সহযোগিতায় রয়েছে কেএস ডিজিটাল, পরিবেশনায় চিত্রভাষা।

মন্তব্য করুন