সালটা ১৯৯০। বরিশাল শহরের একটি হোটেলের কক্ষে একজন নারীর মৃতদেহের পাশে কাঁদছিল সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলেশিশু। নবজাতকের চিৎকার শুনে হোটেলের কর্মচারীরা ছুটে আসেন। শিশুটিকে দেখে সবার মন ছুঁয়ে যায়। কে নেবে শিশুটির দায়িত্ব! এ ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে রাজধানী ঢাকার শ্যামলীর এসওএস শিশুপল্লী কর্তৃপক্ষ তাকে উদ্ধার করে। একটি পরিবার তার দায়িত্ব নেয়, সেখানে বেড়ে ওঠে এ শিশুটিই 'রূপান্তরিত' নারী রানী চৌধুরী। মায়ের নাম আলেয়া বেগম ও বাবা শাহজাহান। এসওএস হারম্যান মেইনার স্কুল অ্যান্ড কলেজে রানীর শিক্ষাজীবন শুরু। বিপত্তি বাধে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। তার মধ্যে অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছিল। ছেলেদের থেকে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা, মেলামেশা, মেয়েদের মতো সাজতে পছন্দ করতেন। শারীরিক গড়ন ছেলের হলেও নিজের মধ্যে সব সময় মেয়ের অস্তিত্ব অনুভব করতেন। শেষমেশ ২০১৮ সালে 'রূপান্তরিত' নারী হিসেবে নিজের নাম লেখান।

মনস্তাত্ত্বিক এই দোটানায় জীবন কখনও থেমে থাকেনি তার; বরং লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোট থেকেই যুক্ত ছিলেন সংস্কৃতিচর্চায়। শৈশব থেকেই নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠার স্বপ্ন তাড়া করত তাকে। কৈশোরে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা) থেকে নাচের ওপর চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করে বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন্যান্সে নাচের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। নৃত্যের গুরু হিসেবে ফারহানা চৌধুরী বেবীর সাহচার্য পান। নৃত্যশিল্পী হিসেবে হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত হয়েছেন। শুধু নৃত্যশিল্পীই নন, মডেল হিসেবে বিশ্বরঙসহ নামিদামি ব্র্যান্ডের কাজ করার সুযোগ হয়েছে তার। স্বপ্নপূরণের পাশাপাশি দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের উন্নয়নের পথে শামিল করতেও কাজ করেন রানী চৌধুরী। তিনি বলেন, 'বিটিভির তালিকাভুক্ত নৃত্যশিল্পী হতে অনেকের মতো আমিও আবেদন করি। বিচারকদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় তুলে ধরি, জানাই- আমি একজন রূপান্তরিত নারী। আমি আমার পরিচয়ে গর্ববোধ করি।'

জন্মের পর থেকে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছেন। বর্তমানে তিনি মানবিক বাংলাদেশ সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে কাজ করছেন। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার রক্ষায় তাদের অংশগ্রহণে দেশে প্রথমবারের মতো রিয়েলিটি শো 'আমিই পারি' আয়োজন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবেন। রূপান্তরিত নারী হওয়ার পর প্রথমদিকে অনেকেই তাকে মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু তিনি নিজের যোগ্যতা দিয়ে আজকে প্রমাণ করে দিয়েছেন এই মানুষগুলোও পিছিয়ে নেই।

এ সমাজে ট্রান্সজেন্ডাররা অবহেলিত। কিন্তু একজন রানী চৌধুরী হেরে যাওয়ার পাত্র নন। তার মতে, 'সমাজে টিকে থাকতে হলে নিজের অধিকার, নিজেকেই আদায় করে নিতে হয়। মানুষ আঘাত দিয়ে কথা বললে ঠান্ডা মাথায় সয়ে গেছি, নিজের কাজ সঠিকভাবে করার চেষ্টা করেছি।'

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়াটা তাদের দোষ নয়। তবুও তারা এই একটা পরিচয়ের কারণে সমাজছাড়া, পরিবারছাড়া। তাদের দুঃখগুলো বোঝা প্রয়োজন। মানুষ বিপদে না পড়লে রাস্তায় নামে না। তাই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। নিজের সমাজসেবামূলক কাজকে প্রসারিত করতে এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের হয়ে অধিকার আদায়ে কাজ করে যেতে চান সব সময়। এ জন্য তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান জাতীয় সংসদে।

মন্তব্য করুন