বান্দরবানের দুই জলপ্রপাত

--
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
দু’পাশে সবুজ পাহাড়। ছোট-বড় পাথরের বুক চিরে তীব্র স্রোতে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জলরাশি। কোথাও কোথাও দুধ সাদা জলরাশি গিয়ে আঁচড়ে পড়ছে নিচে। প্রকৃতির এমন দৃশ্য দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে আমিয়াখুম ও সাতভাইখুমে। লিখেছেন সাদিকুল নিয়োগী পন্নী
তাজিংডং বিজয়ের পর আমাদের লক্ষ্য সাতভাইখুম জলপ্রপাত। তৃষ্ণা, ক্ষুধা ও ক্লান্ত দেহে দুপুরের দিকে ফিরে এলাম শেরকরপাড়ায়। শীতল পানিতে গোসল করে সবাই দলবেঁধে মাচাং ঘরে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। বিকেলে শেরকরপাড়াকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম দোতংপাড়ার উদ্দেশে। আমাদের সঙ্গে গাইড দিদি বম। হাসি-ঠাট্টায় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ১৫ জন সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছুদূর যাওয়ার পর ওয়াই জংশনের দেখা মিলল। একটা পথ একটু ওপর দিয়ে চলে গেছে পাহাড়ের দিকে। আরেকটা নিচের দিকে জঙ্গলের ভেতরে। দিদি বম নিচের পথ দিয়ে যেতে বলল। কিছু সময় হাঁটার পর গহিন জঙ্গলে কেটে রাখা একটি গাছে বসে আটজন বিশ্রাম নিচ্ছি। মিনিট দশেক পার হওয়ার পর বাকি সাতজনের খবর নিই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমাদের চেহারায় ভয় ও আতঙ্কের ছাপ। দিদি বম আমাদের বসতে বলে তাদের খুঁজতে চলে গেল। প্রায় আধঘণ্টা পর বনের রাজা টারজানের মতো দিদি বম তাদের খুঁজে নিয়ে এলো। জঙ্গলে পথ হারিয়ে সাতজন নানা দিকে ছোটাছুটি করেছে এতক্ষণ। হারানো বন্ধুদের পেয়ে সবার মুখে হাসির ঝলক দেখা দিল।
হাতে সময় কম। সবাই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। সন্ধ্যার আগেই গহিন জঙ্গলের পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম দোতং ভ্যালিতে। দিদি বম সম্মানী বুঝে নিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে দিল। কিছু পথ হাঁটার পর অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। জোনাকি পোকার মতো টর্চ লাইটের আলোতে এগিয়ে চলেছি দুর্গম পথ। বসে বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই। মাঝেমধ্যে বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে একটু দম নেওয়া। একসময় সমতল ভূমির দেখা মিলল। জাহিদ ভাই জানালেন, দোতংপাড়া এখান থেকে খুব কাছে। কাকতালীয়ভাবে এখানে নাঈম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো দোতংপাড়ার বন্ধু জ্যাকসনের। আমিসহ সাত-আটজন রয়ে গেলাম। বাকিরা চলে গেল দোতংপাড়ায়। পাহাড়ি বৃক্ষের নিচে বসে আছি। সুনসান নীরবতা। আকাশে তারার হাতছানি। গান-আড্ডায় আধঘণ্টা পার হওয়ার পর ঢালু পথ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। রাত ৮টার দিকে পৌঁছলাম দোতংপাড়ায়।
জ্যাকসন হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানাল। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তার মাচাং ঘরেই। গাছের ডাল দিয়ে বানানো সিঁড়ি বেয়ে ঘরে ওঠানামা করতে হয়। মাচাং ঘরে ব্যাগ রেখে শীতল পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে এলাম। রাতের খাবার পরিবেশন করল জ্যাকসন ও তার স্ত্রী। বিন্নি ধানের চালের ভাত, পেঁয়াজ-মরিচ ভর্তা, মিষ্টিকুমড়া ভাজি, মুরগির মাংস ও ডাল– সবই ছিল অমৃতের মতো। দোতংপাড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের চোখের ঘুম কেড়ে নিল। মাচাং ঘরের বারান্দায় বসে আড্ডা আর গানে কখন যে রাত ২টা বেজে গেল টেরই পেলাম না। ঘুমকাতুরে দু-একজন আড্ডা থেকে বিদায় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল জাহিদ ভাই। আমরা যখন ঘুমাতে গেলাম তখন তার নাক ডাকার শব্দে পুরো মাচাং ঘর কাঁপছে।
ভোরে ঘুম ভাঙল আমার। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি সূর্য তখন দোতং পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঁকি দিচ্ছে। আমাদের বিদায় নিতে হবে মায়ায় ভরপুর দোতংপাড়া থেকে। সকালের নাশতা সেরে ব্যাগ নিয়ে প্রস্তুত সবাই। জ্যাকসন দু’জন গাইড ঠিক করে দিল। পরদিন সকাল ৮টার দিকে দোতংপাড়া থেকে আবার যাত্রা শুরু। দোতংপাড়া থেকে খাড়া ৫০০ মিটার (কমবেশি হতে পারে) পথ নিচে নামতে সবার ঘাম ঝরে গেছে। ঝুরঝুরে মাটি। মনে হয় পা দিলেই পড়ে যাব। নিচে নামার পর জঙ্গলের মতো একটা জায়গায় সমতল ভূমি পাওয়া গেল। সেখানে ১০ মিনিটের মতো বিশ্রাম নিয়ে আবার ট্র্যাকিং। উঠতে হবে প্রায় খাড়া এক হাজার মিটার পথ। পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। দুর্গম পথ ট্র্যাক করে দোতং পাহাড় পাড়ি দিয়ে একটা শালবনের দেখা মিলল। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল প্রায় ১০টা। এখানে শুয়ে-বসে মিনিট পনেরো বিশ্রাম নিয়ে আবার ছুটে চলা। ঝোপঝাড়, বন-জঙ্গল, কণ্টকময় পথ অতিক্রম করার পর ঝরনার পানি পতনের শব্দ কানে ভেসে এলো। শীতল হাওয়া আর জলতরঙ্গের শব্দে সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল। সাতভাইখুম জলপ্রপাতে প্রবেশপথ বেশ খাড়া। জলপ্রপাত দেখার পর এ পথ সবাই চোখের পলকেই পাড়ি দিল। দু’পাশে সবুজ পাহাড়। ছোট-বড় পাথরের বুক চিরে আসছে স্বচ্ছ জলরাশি। আমাদের সঙ্গে রাখা পানি অনেক আগেই শেষ। প্রথমেই সবাই এ জলধারা থেকে তৃষ্ণা মেটাল। তারপর চলল ফটোসেশন। সাতভাইখুম পাড়ি দিয়েই আমাদের যেতে হবে আমিয়াখুম। তাই এখানে বেশি সময় বিরতি দেওয়া হলো না। সাতভাইখুমের জলরাশি পার হয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ট্র্যাকিং শুরু। পিচ্ছিল পথ, ছোট-বড় পাথর আর ঝোপঝাড় মাড়িয়ে একসময় দেখা মিলল জলরাশির। এখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে যেতে হবে আমিয়াখুমের শেষ প্রান্তে। গাইড দু’জন বিদায় নেওয়ার পর নৌকায় চড়ে বসলাম। দু’পাশের পাহাড়ের মধ্যে স্বচ্ছ, শান্ত জলরাশির বুক চিরে আমাদের নৌকা চলছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। পাথর বেয়ে ওপরে ওঠার পর শোনা যাচ্ছিল আমিয়াখুমের জলতরঙ্গের ধ্বনি।
সাতভাইখুম থেকে যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, জলরাশির পতনের শব্দ আমাদের ততই বিমোহিত করছে। কয়েক মিনিট হাঁটার পর চোখের সামনে দৃশ্যমান বাংলাদেশের ভূস্বর্গখ্যাত আমিয়াখুম জলপ্রপাত। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পাশে এ জলপ্রপাতকে অনেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বান্দরবান জেলার থানচি উপজলোর নাইক্ষ্যং নামক স্থানের এ জলপ্রপাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দুর্গম পথ পাড়ি দিতেও প্রকৃতিপ্রেমীরা কুণ্ঠাবোধ করেন না। দু’পাশের সবুজ পাহাড়, ছোট-বড় পাথরের বুক চিরে তীব্র স্রোতে বয়ে যাচ্ছে জলরাশি। কোথাও কোথাও দুধ সাদা জলরাশি গিয়ে আঁচড়ে পড়ছে নিচে। প্রকৃতির এমন দৃশ্য যে কাউকে বিমোহিত করবে। আমাদের দলের সবাই এখানে পৌঁছার পর দিগ্বিদিক হয়ে গেল। মেয়েরা ফটোসেশনের জন্য শাড়ি-গহনা বের করা শুরু করল। কেউ কেউ মেকআপ নিতেও ভুল করেনি। আমার মতো যারা নিঃসঙ্গ শেরপা ছিল, ঝাঁপিয়ে পড়ল জলরাশিতে। বরফের মতো শীতল, কাচের মতো স্বচ্ছ জলধারা বয়ে যাচ্ছে শরীরের ওপর দিয়ে। এ যেন এক স্বর্গীয় সুখ।