বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ জড়িত। প্রতি বছর আবার লাখ লাখ ভ্রমণপ্রেমী মানুষ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার পর্যটন স্থানে ভ্রমণ করে থাকে। ভ্রমণপিপাসু দেশি-বিদেশি পর্যটকের জান-মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা এবং পর্যটকদের বিরুদ্ধে অপরাধের তদন্তের বিষয়কে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশ পুলিশের একটি বিশেষ শাখা হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশ বা পর্যটন পুলিশের অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানসম্মত ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু শুধু সৃষ্টিতেই সন্তুষ্ট থাকলে হবে না। বরং ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিধিকে বিস্তৃত করতে হবে।

পর্যটকদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা, ভ্রমণ অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা, পর্যটকদের আইনগত সহায়তা প্রদান, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রাখা– এমন পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পুলিশ দেশ ও জাতির সেবায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

পর্যটন মৌসুমে ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রয়োজনীয়তা সমধিক। মৌসুম ব্যতীত ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যাবলি অর্ধেক কমে যাওয়া স্বাভাবিক। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে বদলির ব্যবস্থা প্রচলন থাকায় পর্যটন মৌসুমে পরিধি বিস্তৃতির বিবেচনায় ট্যুরিস্ট পুলিশে অভিজ্ঞ, দক্ষ ও মানবসেবায় ব্রত এমন সদস্যকে বদলি করে ইউনিটের কলেবর বৃদ্ধি করা জরুরি। ২০১৭ সালে মোবাইল অ্যাপ ‘হ্যালো ট্যুরিস্ট’ চালু করেছে, যার মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পুলিশ পর্যটন খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ট্যুরিস্ট পুলিশে হেলিকপ্টার ব্যবস্থা থাকা উচিত। দিনের মতো রাতের পর্যটন স্থানও নিরাপদ রাখা জরুরি। এসব করা গেলে দেশি-বিদেশি পর্যটক যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।
পর্যটকের দৃষ্টিসীমায় ট্যুরিস্ট পুলিশের টহল বৃদ্ধি; পর্যটন স্থানগুলোতে একাধিক ট্যুরিস্ট পুলিশ ফাঁড়ি কিংবা নিরাপত্তা চৌকি এবং  সিসি ক্যামেরা স্থাপন; অবকাঠামো, লজিস্টিকস সাপোর্ট, স্থাপনা নির্মাণ; সাইনবোর্ড, বিলবোর্ডসহ বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যম স্থাপন; পরিবহন সেবা ও আবাসিক ব্যবস্থাকে ট্যুরিস্ট পুলিশের সেবার আওতাভুক্ত করা; যানবাহনের টিকিটে ট্যুরিস্ট পুলিশের জরুরি সেবা নম্বর বা হটলাইন নম্বর (+৮৮০১৩২০২২২২২২, +৮৮০১৮৮৭৮৭৮৭৮৭) আবশ্যকভাবে থাকা; পর্যটকদের ভ্রমণকালীন যাবতীয় তথ্য যেমন আসা-যাওয়া, যেখানে থাকবেন সেখানকার তথ্য– সবকিছু লিপিবদ্ধ থাকার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের অনলাইন নিবন্ধন ব্যবস্থা থাকা এবং সে অনুযায়ী কর্মপরিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প ট্যুরিস্ট পুলিশের হাত ধরেই বদলে যাবে।

৯৯৯-এর সেবা যেমন গ্রামের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে, তেমনি পর্যটন মৌসুমে প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু এবং কর্মসূচিতে পরিবর্তন এনে ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিচিতি প্রত্যেক পর্যটক যেন জানতে পারেন, সে ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি।


পর্যটন পুলিশের প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পর্যটকদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করা, কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া, কোনো পর্যটক অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে বা কোনো ধরনের সতর্কবার্তা থাকলে সেটি তাৎক্ষণিক পর্যটকদের অবহিত করা, অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যাওয়া, দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ট্যুরিস্ট পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গে করে থাকেন। রেসকিউ টিম ও বোট; তথ্যকেন্দ্র, সহায়তা ও হেলথ ডেস্ক স্থাপন; পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপন; যে পর্যটন স্থানগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশিং কার্যক্রম নেই সেখানে জরুরি ভিত্তিতে ট্যুরিস্ট পুলিশ অফিস স্থাপন জরুরি। আমরা প্রায় প্রতি বছর দেখে থাকি, পর্যটন মৌসুমে খাবার হোটেল ও আবাসিক হোটেলগুলো কারণে-অকারণে মূল্য বৃদ্ধি করে থাকে। অনেক পর্যটকের সমাগমে সেখানে খাবারের গুণগত মান রক্ষা করা হয় না। তাই ট্যুরিস্ট পুলিশেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সংযুক্ত করা জরুরি যেন প্রয়োজনের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পুলিশ অভিযান চালাতে পারে।

ড. মোহাম্মাদ আনিস রহমান: শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ