বেশ কিছু দিন ধরে শহরের যান্ত্রিক জীবনযাপন ভালো লাগছিল না। রোজ নিয়ম করে সকালে ঘুম থেকে ওঠা, তাড়াহুড়া করে রেডি হয়ে অফিসের জন্য বের হওয়া। এর পর অফিস ছুটি হলে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরে বাসায় ফেরা। কেমন যেন একঘেয়েমি জীবনযাপন। কোথাও প্রকৃতির স্নিগ্ধতা নেই, নেই প্রশান্তি। এরই মধ্যে তিতুমীর কলেজ সাংবাদিক সমিতি ‘স্বস্তির ফুরসত’ শিরোনামে ট্যুরের আয়োজন করে। গন্তব্য সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর ও পানাম নগর। অফিসের কাজ, পত্রিকায় লেখালেখি সবকিছু মিলিয়ে ব্যস্ততা থাকায় একবার ভেবেছিলাম যাব না। পরক্ষণেই বন্ধুদের ঘুরতে যাওয়া নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখে একটা হলুদ পাতার মতো দীর্ঘশ্বাস বুক বেয়ে নিচে নেমে গেল। বন্ধুদের অনুরোধে যাওয়ার জন্য রাজি হলাম। বাবার অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

সকালের নরম সূর্য জানান দিল সকাল হয়ে গেছে। দেরি না করে প্রস্তুত হয়ে ক্যাম্পাসে গেলাম। সবাই একসঙ্গে সকালের নাশতা সেরে তিতুমীর কলেজ ক্যাম্পাসে শহীদ মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ছবি তুললাম। বাসে উঠে বসলাম। বেশ খানিকক্ষণ পর বাস ছাড়ল। পুরো রাস্তা গান ও নাচ করতে করতে আমরা প্রায় সাড়ে ১০টা নাগাদ কাঙ্ক্ষিত স্থান সোনারগাঁ লোক ও কারুকার্য শিল্প ফাউন্ডেশনের সামনে পৌঁছালাম।  এর পর সবাই একজোট হয়ে জাদুঘরের ভেতরের ঢুকলাম। জাদুঘরের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল একটি ভাস্কর্য রয়েছে, যা দেখে মনে হয়েছে হাতের শাহাদাত আঙুলটি উঁচু করে তিনি ৭ মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণ দিচ্ছেন। এর পর আমরা জাদুঘরে প্রবেশ করলাম নিচতলা থেকে কারুকার্যগুলো দেখতে দেখতে আমরা তৃতীয় তলা পর্যন্ত উঠলাম। ক্ষুদিরামসহ কাঠের তৈরি বিভিন্ন প্রকার নৌকা, মাটির তৈরি বিভিন্ন নকশা ও জাদুঘরের ডান পাশের দেয়ালে কাচের ভেতর গ্রামবাংলার গ্রামীণ মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর পর জাদুঘর থেকে বেরিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। যেহেতু আমাদের টিমে ৪০ জন সদস্য ছিল তাই আমরা সবাই একসঙ্গেই ছিলাম পুরোটা সময়।

সাঁকো ও ব্রিজ পেরিয়ে আমরা খোলা মাঠের দিকে এগিয়ে চলেছি, চারদিকে আম ও কাঁঠাল গাছ রয়েছে।  এ ছাড়া রয়েছে বসন্তের নিদর্শন কৃষ্ণচূড়া গাছ। থোকায় থোকায় লাল ফুলগুলো থেকে কিছুতেই চোখ সরাতে পারছিলাম না। প্রায় ৪ হাজার ৫শর অধিক প্রাচীন নিদর্শন স্থান পেয়েছে সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘরে। মাঠের একাংশজুড়ে নাগরদোলা ও বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য বেশ কিছু খেলার ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রকৃতি ঘুরে ঘুরে দেখার পরই সেখানে আমাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ছেলেদের ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ছেলেদের খেলার ফাঁকে আমরা মেয়েরা কারুকার্যপল্লি ঘুরতে বের হই। অসাধারণ সব জামদানি শাড়ির কালেকশন রয়েছে সেখানে। যদিও দামটা বেশ বেশি; তবে সেখানকার শাড়ির কোয়ালিটি খুবই ভালো।  শুধু শাড়ি নয়, সেখানে আরও পাবেন থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, মেয়েদের সব ধরনের অলংকার, মাটির তৈরি কারুকার্য সম্পন্ন বাহারি সব জিনিসপত্র। কারুশিল্প পল্লি ঘুরে এসে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে ফেলি। এর পর মেয়েদের এই আছি এই নেই ও অন্ধের হাঁড়িভাঙা খেলা অনুষ্ঠিত হয় এবং লটারি খেলার মাধ্যমে সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘরকে বিদায় জানিয়ে আমরা প্রায় ৪টা থেকে সাড়ে ৪টা নাগাদ বিশ্বের ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া ১০০টি নগরীর মধ্যে অন্যতম স্থানপ্রাপ্ত পানাম নগরী পৌঁছাই।

সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পানাম নগরীর দূরত্ব মাত্র ৫-১০ মিনিটের। পানাম নগরী ঢুকতেই ইতিহাসের সেই প্রাচীন যুগে ফিরে যাই আমরা। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরোনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বারো ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতিটি দালান কারুকার্যের দিক থেকে ভিন্ন একটি দালানে আমার চোখ আটকে গেল সেটা হলো, পানাম নগরীর পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যবাহী দালান ‘কাশীনাথ ভবন’ সন-১৩০৫। এই সনটি লেখা দেখার পর থেকে আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন অতীতের সেই সময়ে ফিরে গেছি।  পানাম নগরীতে বেশ কিছু পুকুরঘাটও রয়েছে। পানামের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বাড়ি উল্লেখযোগ্য। পানাম সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি রয়েছে। বাড়িগুলোর অধিকাংশই আয়তাকার, উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত, উচ্চতা একতলা থেকে তিনতলা। বাড়িগুলোর স্থাপত্যে ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও মোগল, গ্রিক এবং গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পকুশলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। প্রতিটি বাড়িই ব্যবহারোপযোগিতা, কারুকাজ, রঙের ব্যবহার এবং নির্মাণ কৌশলের দিক দিয়ে উদ্ভাবনী কুশলতায় ভরপুর। ইটের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই-লোহার তৈরি ব্র্যাকেট, ভেন্টিলেটর আর জানালার গ্রিল। মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খিলান ও ছাদের মধ্যবর্তী স্থানে নীল ও সাদা ছাপ দেখা যায়। এ ছাড়া বাড়িগুলোতে নকশা ও কাস্ট আয়রনের কাজ নিখুঁত।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এবার যে ফিরতে হবে। আমাদের বাস ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। রাত সাড়ে ৮টার মধ্যে ক্যাম্পাসে পৌঁছলাম। সোনারগাঁয়ে কাটিয়ে আসা লোকশিল্প ও পানাম নগরী ঘুরে আনন্দদায়ক অনুভূতি নিয়ে বাসায় ফিরলাম।