- ভ্যালেনটাইন্স
- প্রযুক্তিময় ভালোবাসা
প্রযুক্তিময় ভালোবাসা

প্রযুক্তির সংস্পর্শে বদলে যাওয়া বিশ্বে তরুণ প্রজন্ম প্রিয়জনকে খুঁজে নেওয়ার পাশাপাশি হৃদয়ের অনুভূতি বিনিময়ে ব্যবহার করছে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি ডিভাইস। নতুন সময়ে এসে প্রযুক্তির স্পর্শে বদলে গেছে প্রেমের ভাষা, গতি ও ধরন। সম্পর্কের জালে জড়ানোর জন্য এখন আপনার হাতের মুঠোয় হরেক মাধ্যম। ইন্টারনেটের সমুদ্রে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমোর মতো অডিও-ভিডিও চ্যাটিং সেবা। ভিডিও কলিংয়ের মাধ্যমে মুহূর্তেই এখন মুখোমুখি হওয়া যায় প্রিয়জনের। অনুভূতিগুলো এখন ইমোজি হয়ে স্ট্ক্রিনে ভেসে ওঠে। প্রযুক্তিময় হয়ে উঠেছে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যমতে, দেশে মোবাইল সিম গ্রাহক ১৮ কোটি ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। ইন্টারনেট গ্রাহক ১২ কোটি ৩৪ লাখের বেশি। একজন একাধিক সিম ব্যবহার করায় প্রকৃতপক্ষে কতজন সেলফোন ব্যবহার করছেন, তা বলা কঠিন। তবে এটি বলা যায়, দেশের প্রত্যেক তরুণ-তরুণীর হাতে এখন ফোন, যার অধিকাংশই ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন। সম্পর্কে জড়ানোর এই সহজ মাধ্যমে সহজেই আকৃষ্ট করছে মানুষকে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে। আন্তর্জাতিক জরিপগুলো বলছে, প্রযুক্তির স্পর্শে এখন সম্পর্কগুলো খুব দ্রুত তৈরি হচ্ছে। ইন্টারনেটের অবারিত জগতে ঢুকে ক্লিকেই খুঁজে নেওয়া যাচ্ছে প্রিয় মানুষটাকে। দূরত্বের সীমানা ঘুচে রঙিন হয়ে উঠছে প্রিয় মুহূর্ত।
রোমান্টিক সম্পর্কের ওপর আন্তর্জাতিক জরিপ প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার দেখিয়েছে, প্রেম যখন প্রযুক্তিনির্ভর তখন অন্যান্য খাতের মতো রোমান্টিক সম্পর্কে গতিপথ নির্ধারণ করছে প্রযুক্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো আছেই, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডেটিং ও ম্যাচমেকিং প্ল্যাটফর্ম। প্রযুক্তি ডিভাইস ও ইন্টারনেটের কল্যাণে প্রিয়জন চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। একান্ত প্রিয়জনকে খুঁজে নিতে মানুষ এখন ঢুঁ মারছে টিন্ডার, বাম্বেল, ম্যাচ, ইহারমোনি, অকুপেইড, গ্রিন্ডারের মতো ডেটিং প্ল্যাটফর্মে। এসব প্ল্যাটফর্মে বিনামূল্যের পাশাপাশি অর্থ খরচায় মেলে বাড়তি ফিচার ও সুবিধা। ডেটিং প্ল্যাটফর্মের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়টির নাম টিন্ডার। প্ল্যাটফর্মটিতে প্রতি মাসে সাত কোটি ৫০ লাখ ব্যবহারকারী ঢুঁ মারেন। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতে টিন্ডার প্ল্যাটফর্মটির বাংলা সংস্করণও রয়েছে। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটির বাজারমূল্য এখন ৪৫ বিলিয়ন ডলার! ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ অনলাইন ডেটিং সেবায় যুক্ত হবে ৪১ কোটিরও বেশি মানুষ। আর এতে পেইড সার্ভিসের মাধ্যমে সেবাদাতা প্ল্যাটফর্মগুলো ৩৭০ কোটি ডলারেরও বেশি আয় করবে। প্রিয়জনকে খুঁজে নিতে কিংবা দিতে দেশেও গড়ে উঠেছে বেশকিছু ম্যাচমেকিং প্ল্যাটফর্ম। এর মধ্যে রয়েছে বরবধূ ডটকম, সেন্সিবল ম্যাচ ডটকম, ম্যারিজম্যাচ বিডি প্রভৃতি। ফেসবুককেন্দ্রিক নানা গ্রুপ ও পেজও রয়েছে।
স্ট্যাটিস্টার জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ১৫.৭ ভাগ (পাঁচ কোটি ৩০ লাখ) মানুষ অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে ডেটের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। সম্পর্কের বাঁধনে জড়াতে দেশটিতে অনলাইনে প্ল্যাটফর্মের এখন ৮২ কোটি ৯০ লাখ ডলারের বাজার গড়ে উঠেছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতেও অনলাইন প্রেমের বাজার ঈর্ষণীয়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুক্তরাজ্যের ১১.৫ ভাগ, ফ্রান্সের ১০.৯ ভাগ মানুষ সম্পর্কে জড়াচ্ছেন। অনলাইনে গাঁটছড়া বাঁধার ঢেউ আছড়ে পড়েছে আমেরিকা, ইউরোপ হয়ে এশিয়াতেও। চীনে ৬ শতাংশ এবং ভারতে ৩.৪ শতাংশ মানুষ প্রিয়জনকে খুঁজে নিতে অনলাইন মাধ্যমের দ্বারস্থ হচ্ছেন। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরাও যে ধীরে ধীরে ম্যাচমেকিং ও ডেটিং সাইটের দিকে ঝুঁকছেন- সুনির্দিষ্ট ডাটা না থাকলেও সেটি বলে দেওয়া যায়।
তবে প্রযুক্তি সম্পর্ক তৈরির প্রেক্ষাপট যত সহজ করে দিয়েছে, সম্পর্কের জটিলতা তৈরিতেও ভূমিকা রাখছে। সঙ্গী সেলফোনে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিক সময় ব্যয় করছে এমন অভিযোগ অহরহ। জরিপে অংশগ্রহণকারীর ২৪ শতাংশ বলছেন, সঙ্গী অধিক সময় ধরে সেলফোন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করায় তারা বিরক্ত। জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৫১ শতাংশ আমেরিকান বলছেন, সেলফোনে প্রেমিক বা প্রেমিকার থেকে তারা বিভ্রান্তিকর তথ্য পেয়েছেন। ৮১ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী বলছেন, তারা কখনও না কখনও অন্যের সম্পর্কগত স্ট্যাটাস চেক করেছেন। ৪৬ ভাগ বলেছেন, তারা এটাই প্রায়ই করে থাকেন। ৫৩ ভাগ ব্যবহারকারী বলেছেন, তারা অন্যের প্রোফাইলে গিয়ে দেখেন তারা সিঙ্গেল নাকি কারও সঙ্গে সম্পর্কে আছেন, নাকি বিবাহিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পর্কের চর্চা তো হয়ই। অনেকে বলেছেন, সামাজিক মাধ্যমে পুরোনো সম্পর্কেরও খোঁজ রাখেন। একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত দু'জনের মজার তথ্যও উঠে এসেছে এ জরিপে। ১৮ থেকে ২৯ বয়স শ্রেণি বলছে, তারা তাদের সঙ্গীকে কতটা ভালোবাসে, সেটা প্রকাশে সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কারণ, এখানে প্রকাশ্যে সবার সামনে নিজের ভালোবাসাটা প্রকাশ করায় এক ধরনের গৌরব ও অহংকার বোধ থাকে তাদের। তবে এই শ্রেণির মধ্যে সম্পর্কে জড়ানো দু'জন মানুষের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে অনেক সময় নেতিবাচক প্রভাবও ফেলছে। বিশেষ করে একজন কার স্ট্যাটাসে কী ধরনের মন্তব্য করছে, লাইক দিচ্ছে। এ ধরনের আচরণের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ২৩ শতাংশ প্রেমিক বা প্রেমিকা তার প্রিয়জনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কারণে ঈর্ষান্বিত। এ প্রবণতা ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়স্কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তবে ডিজিটাল মাধ্যমে নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় পর্বের পর সম্পর্কে জড়ানোর প্রেক্ষাপটে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে। এ ধরনের সম্পর্কে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন খবর প্রায়ই শোনা যায়। ডিজিটাল মাধ্যমের প্রোফাইলকে অন্ধবিশ্বাস করলে প্রতারণায় পড়ার শঙ্কা থাকে। এ ক্ষেত্রে সম্পর্কে জড়ানোর আগে ভালোভাবে ব্যক্তির পরিচয়, প্রোফাইলের তথ্য যেটি তিনি দিয়েছেন, সেগুলো যাচাই করা জরুরি। নানাভাবে সেটি যাচাই-বাছাই করা সম্ভব। ব্যক্তির প্রোফাইল ও কমন ফ্রেন্ড তালিকা ভালো করে ঘাঁটলেই অনেক তথ্য পরিস্কার হওয়া যায়।
এত কিছুর পরও ডিজিটাল মাধ্যমে প্রেমকে আরও জমজমাট করতে আসছে নতুন নতুন প্ল্যাটফর্ম। বিশেষ করে বলতে হবে ফেসবুকের মেটাভার্সের কথা। যেখানে নিজের অ্যাভাটার তৈরি করে সরাসরি কাল্পনিক ত্রিমাত্রিক জগতে মুখোমুখি হওয়া যাবে প্রিয়জনের। এমন দিনও খুব বেশি দূরে নয়, যখন ভার্চুয়াল মাধ্যমে চোখে দেখার পাশাপাশি মিলবে স্পর্শেরও অনুভূতি। ইতোমধ্যে সে রকম ঘোষণা তো দিয়েই রেখেছেন ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। ভবিষ্যতের মেটাভার্সে তৈরি হবে কপোত-কপোতীর নিজস্ব জগৎ। হাজার মাইলের দূরত্ব ঘুচিয়ে প্রিয়জন চলে আসবে খুব কাছে। কল্প জগতে তৈরি আপনার কোনো প্রিয় মুহূর্তে প্রিয় স্থানে বসে ছুঁয়ে দেবেন প্রিয়জনকে। মিলবে সান্নিধ্য। তবে যত যাই হোক, সরাসরি বসে খুব কাছ থেকে প্রিয় মানুষটির ছুঁয়ে দেখার স্বর্গীয় অনুভূতি কেবল সরাসরিতেই মিলতে পারে তা না বললেও চলে।
মন্তব্য করুন