‘হতাশাগ্রস্ত’ ছিলেন সাদিয়া তাবাসসুম
রাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১২ মে ২০২২ | ২১:১২ | আপডেট: ১২ মে ২০২২ | ২২:৫৩
ক্যারিয়ার নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন সাদিয়া তাবাসসুম। করোনার কারণে দীর্ঘদিন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় পড়ালেখার দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছিলেন। এ নিয়ে তার মধ্যে ছিল হতাশা। যে হতাশার কারণেই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেন সাদিয়া। এমনটাই দাবি করছে তার পরিবার ও পুলিশ।
সাদিয়া তাবাসসুম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মাওহা ইউনিয়নের বিশমপুর। সাদিয়ার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ও মা স্কুল শিক্ষক। গত মঙ্গলবার বিকেলে গ্রামের বাড়ি থেকে সাদিয়ার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে তার পরিবারের দাবি। এসময় সাদিয়ার লেখা একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়। যেখানে তিনি লেখেন, 'চোরাবালির মতো ডিপ্রেশন, বেড়েই যাচ্ছে, মুক্তির পথ নেই, গ্রাস করে নিচ্ছে জীবন, মেনে নিতে পারছি না।'
সাদিয়া হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করেছে বলে দাবি করেছে তার পরিবার। এ প্রসঙ্গে তার বাবা মাহবুবুর রশিদ বলেন, মেয়ে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। যে হতাশা তাকে আর ফিরতে দেয়নি। সেদিন কেউ বাড়ি না থাকার সুযোগে এমন কাজ করেছে।গৌরীপুর থানার ওসি খান আব্দুল হালিম সিদ্দিকী বলেন, সুরতহাল রিপোর্টে গলায় ফাঁসের দাগ ছাড়া শরীরের কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন পাইনি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে সঠিক ঘটনা জানা যাবে। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার বিকেলে তার পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। ওইদিনই তাকে দাফন করা হয়েছে।
আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে ওসি বলেন, তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন তিনি ক্যারিয়ার নিয়ে বেশ হতাশায় ছিলেন। তিনি পড়ালেখা শেষ করতে পারছে না, বন্ধুরা অনেকে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি-বাকরি করছে এটি নিয়ে হতাশায় ছিল। করোনার কারণে দীর্ঘদিন লেখাপড়া বন্ধ থাকায় সে পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়েছিল। বিভাগেও তার ফল ভালো। সবমিলিয়ে তিনি ক্যারিয়ার নিয়েই অধিক দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
করোনার কারণে পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে বলে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীরা। এজন্য শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে এবং নিয়মিত কাউন্সিলিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ তুষার বলেন, করোনা শুরুর পর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার পরিমাণ বেড়েছে। হতাশা বাড়ার পেছনে নানা কারণ রযেছে। দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় তারা পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়েছে। আর এখন হঠাৎ করে ক্যারিয়ার নিয়ে এগোতে গিয়ে অনেকে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। আবার দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যে একাকিত্ববোধ বেড়েছে। ফলে এখন ক্যাম্পাসে এসে তারা বন্ধু-বান্ধব, ক্লাসসহ অন্যান্য পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি প্রায় দুই বছর করোনায় ঘরবন্দী শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী পারিপার্শিক, সামাজিক বৃদ্ধিটা ততটা হয়নি। যার কারণে তারা বয়স অনুযায়ী সামাজিক আচরণ করতে পারছেন না কেউ কেউ। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিপ্রেশন অধিকহারে বেড়েছে। যারা ঠিকমত কাউন্সিলিং পেয়েছেন তারা ভালোভাবে ফিরে আসছেন। আর যারা কাউন্সিলিং পাননি, কিন্তু তাদের ডিপ্রেশন লেভেল অধিক রয়েছে তারা অপ্রত্যাশিত এসব ঘটনা বেছে নিচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তানজির আহম্মদ তুষার বলেন, আত্মহত্যার মতো এমন ঘটনা এড়াতে হলে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অধিক নজর দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা কি করে, কোথায় যায় এসবও নজর রাখতে হবে। নিয়মিত কাউন্সিলিং করতে হবে সবাইকে। কেউ হতাশাগ্রস্থ হলে তাকে একা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক, পরিবার তাদেরকে সবসময় দেখাশোনা করে মানসিক সার্পোট দিতে হবে। তবেই এমন ঘটনা এড়াতে পারবে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ঈদের ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন সাদিয়া। আগামী সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার কথা ছিল তার। কিন্তু মঙ্গলবার ওই ছাত্রী নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে আঁড়ার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস দেন। দীর্ঘ সময় তার কোনো খোঁজ না পেয়ে সাদিয়ার চাচাতো বোন তাকে ডাকাডাকি করেন। তাতেও কোনো সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে সাদিয়াকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।